একজন ভদ্রমহিলা বাসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তিনজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে গেলেন। মুহূর্তের মধ্যেই তিনজনের মধ্যে তর্কাতর্কি হাতাহাতিতে রূপ নিল। ঘটনা বেশিদূর এগোনোর আগেই হেলপার সবাইকে ঠান্ডা করল। কাহিনীটা খুবই স্বাভাবিক-বয়স্ক ওই ভদ্রমহিলা বাসে উঠেছেন দেখে তাঁরা তিনজনই নিজের আসন ছেড়ে দিয়ে ওই মহিলাকে বসতে দিতে চেয়েছিলেন। সবারই এক কথা, ‘উনি আমার সিটে বসবেন।’ ব্যাপারটা বুঝতে পারার পর বুকটা আমার গর্বে ভরে উঠল-আহা! আমার সোনার দেশ! অথচ কোনো এক দেশের কথা সেদিন পত্রিকায় পড়লাম, সে দেশে নাকি মহিলাদের জন্য বাসে সংরক্ষিত আসন রাখা আছে, তার পরও নাকি ছেলেরা সেসব আসনে বসে থাকে; মহিলারা বললেও তারা আসন ছাড়ে না, নানা রকম তত্ত্ব বয়ান করে।
বাস আবার চলতে শুরু করেছে। আমার পাশের আসনের লোকটি সাত দিনের অভুক্ত মানুষের মতো বাদাম চিবিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ছাগলটা বাদামের ছাল পকেটে রাখছে কেন? বাদাম খেয়ে পেট না ভরলে বোধহয় ছাল খাওয়া শুরু করবে। বাস এত দ্রুত যাচ্ছে, আমার অফিসের তো এখনো তালাই খোলা হয়নি। বাসটা সিগন্যালে থামল। অমনি পাশের লোকটা দৌড়ে বাস থেকে নেমে রাস্তার পাশের ডাস্টবিনে বাদামের ছালগুলো ফেলে আবার বাসে উঠল। আহা! ধন্যি ধন্যি আমার দেশের মানুষ!! পুরোনো এয়ারপোর্টের সামনের সিগন্যালে নেমে পড়লাম। ফুটপাত দিয়ে হাঁটছি। হঠাৎ দেখি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী হেঁটে হেঁটে তাঁর কার্যালয়ের দিকে যাচ্ছেন! সঙ্গে কোনো পুলিশ বা অন্য কাউকে দেখতে পেলাম না। আমার একেবারে কাছাকাছি চলে এলে মুচকি হেসে সালাম দিলাম। আন্তরিক ভঙ্গিতে সালামের উত্তর দিলেন, রাস্তায় দাঁড়িয়েই কেমন আছি, কী করছি, বাসায় কে কে আছে জানলেন। এদিকে আমার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে, চা-বিস্কুট না খাইয়ে তিনি ছাড়বেনই না। অনেক কষ্টে রেহাই পেলাম তাঁর হাত থেকে। মোটামুটি দৌড়ে দৌড়ে অফিসের দিকে যাচ্ছি, তখন দেখলাম এক ট্রাফিক সার্জেন্ট এক বাস-চালককে গরম পানি দিয়ে কুলকুচা করাচ্ছে আর তার হাত ধুয়ে যাচ্ছে। ওই বাসের যাত্রীদের কাছে জানতে পারলাম, কাগজপত্রহীন ওই বাসটি ট্রাফিক সার্জেন্ট আটকানোর পর ড্রাইভার ঘুষ দিতে চেয়েছিল। এমন অন্যায় কথা যে মুখ দিয়ে বলেছিল, সেই মুখ পরিষ্কার করতেই এই কুলকুচা, আর যে হাত দিয়ে ঘুষ দিতে চেয়েছিল সেই হাত ধোয়ার অভিযান চলছিল। আহা! ওহো! আহ্হ্! শান্তি! সোনার দেশ আমার! সেদিন বিদেশি কোনো পত্রিকায় পড়লাম-সে দেশে ট্রাফিক সার্জেন্টরা রাস্তা আটকে চাঁদাবাজের মতো চালকদের কাছ থেকে বখরা আদায় করে। কোথায় সে দেশ আর কোথায় আমার সোনার বাংলাদেশ! আহা!
দৌড়াতে দৌড়াতে অফিসে ঢুকে দেখি, সবাই নিজ নিজ ডেস্কে বসে কাজ করছে। অথচ ইন্টারনেটে সেদিন এক দেশের কথা পড়লাম, সে দেশে অফিস সময়ে নাকি কাউকে পাওয়াই ভার; বেশির ভাগ সময়ই তারা বিভিন্ন চ্যানেলে টক শোতে কাটায়। সত্যি বিচিত্র সেসব দেশ! তারা আমাদের এই সোনার দেশকে যে কেন আদর্শ হিসেবে নেয় না, বুঝি না।
মেহেদী মাহমুদ আকন্দ
সূত্রঃ প্রথম আলো, জুলাই ২০, ২০০৯
rakib
সেরা