ব্যারন ম্যুনহাউজেন
ছাদে ঝুলছে ঘোড়া
ঘোড়ায় চড়ে রাশিয়া যাচ্ছিলাম। সময়টা ছিল শীতকাল। প্রবল তুষার পড়ছিল। চলতে চলতে আমার ঘোড়াটি এত ক্লান্ত হয়ে গেল যে বেচারা হোঁচট খেতে লাগল। সেই সঙ্গে আমারও প্রচণ্ড ঘুম পেতে লাগল। পথে একটি বাড়িও আমার নজরে পড়েনি। কী আর করা! বাধ্য হয়ে খোলা ময়দানেই শুয়ে পড়তে হলো। কিন্তু কী মুশকিল! চারদিকে কোনো ঝোপঝাড়, গাছ কিছুই নেই। কেবল একটা ছোট্ট খুঁটি বরফের মাঝখানে বের হয়ে আছে। সেই খুঁটির সঙ্গেই আমার ঘোড়াকে কোনোমতে বেঁধে শুয়ে পড়লাম।
সকালে ঘুম ভাঙতেই কী অবাক কাণ্ড! মাঠ, বরফ সব উধাও। দেখতে পেলাম মাঠের পরিবর্তে আমি একটি গ্রামের রাস্তায় শুয়ে আছি। চারদিকে শুধু বাড়ি আর বাড়ি। ব্যাপার কী? আমার ঘোড়াটাই বা গেল কোথায়? হঠাৎ শুনি আমার ঘোড়ার সেই পরিচিত ডাক। কিন্তু কোথায় সে? শব্দটি আসছে যেন আকাশ থেকে। ওপরে তাকিয়ে দেখলাম, আমার ঘোড়াটি এক গির্জায় ঝুলছে। তাও আবার বাঁধা আছে একেবারে একটি ক্রুশের সঙ্গে।
এবার ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হলো। গতকাল তুষার পড়তে পড়তে শহরটি মানুষসহ বরফে চাপা পড়েছিল। গির্জা উঁচু ছিল বলে এর ছাদের ক্রুশ বরফ থেকে বের হয়েছিল। আমি না বুঝে এই ক্রুশটাকে খুঁটি ভেবে এর সঙ্গে ঘোড়াটা বেঁধেছিলাম।
আর রাতে যখন আমি ঘুমাচ্ছিলাম, আক্নিক গরম পড়ায় সব বরফ গলে যায়। সেই সঙ্গে আমিও বরফের নিচের মাটিতে পড়ে থাকি। কিন্তু আমার বেচারা ঘোড়াটি ওপরেই রয়ে যায়। কেননা, সে তো ক্রুশের সঙ্গে বাঁধা ছিল।
কী করা যায়? মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলাম। টান মেরে আমার পিস্তলটা বের করে নিশানা ঠিক করি এবং দড়ির ঠিক মাঝখানে গুলি করি। দড়ি দুই ভাগ। ঘোড়াটি উল্কাবেগে আমার কাছে নেমে এল। আমি লাফ দিয়ে ঘোড়ার পিঠে উঠে বাতাসের বেগে ছুটতে থাকি।
নেকড়ে টানা গাড়ি
কিন্তু শীতকালে বরফের ওপর ঘোড়ায় চলতে খুবই অসুবিধা। তার চেয়ে ঘোড়াচালিত ্লেজে চলা উত্তম। তাই আমি একটি ভালো ্লেজ গাড়ি কিনে বরফের ওপর তীরবেগে ছুটতে লাগলাম।
সন্ধ্যার দিকে চলতে চলতে আমি এক বনে প্রবেশ করলাম। হঠাৎ শুনতে পেলাম ঘোড়ার ভীতসন্ত্রস্ত ডাক। পেছন ফিরে দেখি ধারালো দাঁতযুক্ত মুখ হাঁ করে এক ভয়ঙ্কর নেকড়ে আমার ্লেজের পেছনে ছুটছে।
বাঁচার কোনো আশাই ছিল না। আমি ্লেজের মেঝেতে শুয়ে ভয়ে চোখ বন্ধ করলাম। আমার ঘোড়াটি পাগলের মতো ্লেজ টেনে ছুটে যাচ্ছিল। আমি ঠিক আমার কানের কাছে নেকড়ের গর্জন শুনতে পেলাম। কিন্তু ভাগ্যের ব্যাপার, নেকড়েটি আমাকে খেয়ালই করল না।
সে লাফ দিয়ে আমার ঘোড়ার ওপর চড়াও হলো। নিমিষে ঘোড়ার পেছনের অর্ধেক অংশ তার ক্ষুধার্ত পেটে অদৃশ্য হয়ে গেল। সামনের অংশটি তখনো আতঙ্ক আর ব্যথায় ছুটছিল। নেকড়েটি ক্রমেই সামনের অংশটিকে খেয়ে ফেলতে লাগল। আমার বোধোদয় হতেই আমি মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ছোঁ মেরে চাবুকটি তুলে নিয়ে জন্তুটাকে চাবকাতে শুরু করলাম। সে ব্যথায় অস্থির হয়ে সামনে লাফ দিল এবং নেকড়েটি লাগামের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
আমি নেকড়েটাকে চাবকাতে থাকলাম। সে বাধ্য হয়ে ্লেজটিকে তীরবেগে টেনে চলল। তিন ঘণ্টা পর এরূপ অদ্ভুত দৃশ্য দেখে পিটার্সবার্গের মানুষ মুগ্ধ হয়ে দলবেঁধে রাস্তায় নেমেছিল ভয়ঙ্কর নেকড়েকে কাবু করা বীরকে দেখতে।
অবিশ্বাস্য শিকার
পিটার্সবার্গের বিস্তীর্ণ হ্রদে অসংখ্য বুনোহাঁস কিলবিল করছিল। এদিকে আমার বন্দুকে একটিও গুলি ছিল না। হঠাৎ মনে পড়ল, আমার ব্যাগে রাখা এক টুকরা চর্বির কথা। হুররে! ব্যাগ থেকে চর্বি বের করে তাড়াতাড়ি সেটা লম্বা চিকন রশির সঙ্গে বেঁধে পানিতে ফেলে দিই।
একটি হাঁস লোভীর মতো তা গিলে ফেলে। কিন্তু চর্বি ছিল পিচ্ছিল এবং তা দ্রুত হাঁসটির পাকস্থলী অতিক্রম করে পেছন দিয়ে বের হয়। এভাবে হাঁসটি আমার রশিতে গাঁথা হয়ে যায়। অতঃপর আরেকটি হাঁস চর্বির নিকটবর্তী হয় এবং তার বেলায়ও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে।
একের পর এক হাঁসগুলো চর্বি গিলতে থাকে এবং আমার রশিতে গেঁথে যায় ঠিক যেন মালার মতো। ১০ মিনিট যেতে না যেতেই সব কটা হাঁস আমার রশিতে বন্দী হয়ে গেল।
খেঁকশিয়াল সুচের মাথায়
একবার রাশিয়ার গহিন জঙ্গলে আমি খেঁকশিয়ালের দেখা পেয়েছিলাম। তার চামড়াটা এত সুন্দর ছিল যে গুলি করে চামড়াটা নষ্ট করতে মায়া হলো।
এক মিনিটও সময় নষ্ট না করে আমি বন্দুক থেকে গুলি বের করে সেখানে একটা সুচ ভরলাম; ঠিক যেমনটি মুচিরা জুতা সেলাইয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে। সুচ ভরা শেষ হতেই আমি খেঁকশিয়ালটিকে গুলি করলাম।
খেঁকশিয়ালটি একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল বলে সুচটা তার লেজ ভেদ করে তাকে গাছের সঙ্গে গেঁথে ফেলল। আমি তাড়াহুড়ো না করে খেঁকশিয়ালটির কাছে হেঁটে গেলাম এবং চাবুক দিয়ে তাকে চাবকাতে শুরু করলাম।
খেঁকশিয়ালটি ব্যথায় এত উন্মাদ হয়ে গেল যে বিশ্বাস করবেন কি না জানি না। কিন্তু সে তার চামড়া থেকে বেরিয়ে এসে সম্পূর্ণ খালি গায়ে পালিয়ে গেল। আর চামড়াটি আমি পেয়ে গেলাম একেবারে অক্ষত অবস্থায়।
ব্যারন ম্যুনহাউজেনঃ ইতিহাস বিখ্যাত গুলগল্প সম্রাট ছিলেন ব্যারন। ১৭২০ সালে জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর বলা গল্পগুলো রুড্লফ এরিখ রাসপে সংগ্রহ করে ১৭৮৬ সালে দি অ্যাডভেঞ্চার অব ব্যারন ম্যুনহাউজেন নামে প্রকাশ করেন।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১৩, ২০০৯
Leave a Reply