আমার অস্থিরতা শুরু হলো মিলির ফোন আসার পর। সে আমাকে ডাকে ‘বর’। বর ডাকাই সংগত। কারণ, কয়েক দিন আগে গোপনে আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। বিয়ের পর একটি মেয়ে আহ্লাদ করে তার স্বামীকে বর ডাকতেই পারে। সেই স্বামী যতই অপদার্থ হোক।
আমি পুরোপুরি অপদার্থ না হলেও কিছুটা অপদার্থ টাইপ। বাজে একটা সাবজেক্টে মাস্টার্স করেছি। চাকরিবাকরি পাইনি। স্কুলের নিচু ক্লাসের দুটো গবেট ছাত্র পড়াই। ওতে আমার হাতখরচটা চলে। বাবা ছোট চাকরি করতেন। সাত মাস হলো রিটায়ার করেছেন। সংসার চলে এখন বাবার পেনশনের টাকায়। পুরান ঢাকার বিশাল এক ছয়তলা বাড়ির ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকি আমরা। বাড়িটা মিলিদের। ওরা দোতলায় দুটো ফ্ল্যাট জোড়া দিয়ে একটা করে থাকে। বাকি বাইশটা ভাড়া দেওয়া। মিলি তার মা-বাবার একমাত্র মেয়ে। ভাবা যায়, এই মেয়ের সঙ্গে আমার প্রেম!
ঘটনাটা অবশ্য আমি আর মিলি ছাড়া কেউ জানে না।
আমাদের ঘটনা সিনেমার মতো। এই বাড়িতে ভাড়াটে হিসেবে আসার পরই মিলির সঙ্গে আমার প্রেম হয়। কয় দিন আগে গোপনে আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। গোপনে বিয়ে সেরে না রাখলে ওর জাঁদরেল বাপ কিছুতেই তাঁর একমাত্র মেয়ের সঙ্গে আমার মতো অপদার্থের বিয়ে দেবেন না। আমরা দুজনেই আছি দুই কঠিন বাপের পাল্লায়। মিলির বাপ জাঁদরেল আর আমার বাপটা খুবই খ্যাড়খ্যাড়া টাইপের। রিটায়ারমেন্টের পর সারাক্ষণ বাড়িতে বসে থাকেন আর আমার মুণ্ডুপাত করেন।
আমি একটু স্বপ্নজীবী টাইপের ছেলে। সারাক্ষণ মিলিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি। মিলির ফোন এলে দরজা বন্ধ করে, চোরের মতো ফিসফিস করে কথা বলি। আপন বউয়ের সঙ্গে ‘তোমাকে খুব ভালোবাসি’ কথাটাও গলা খুলে বলতে পারি না।
এই পরিস্থিতিতে মিলি বলেছে, আজ আমার রুমে বাসররাত হবে। সন্ধ্যা থেকে আষাঢ় মাসের ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টিই রোমান্টিক করে তুলেছে মিলিকে। একটু রাত হওয়ার পর নিঃশব্দে নিজের রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে আসবে সে। তার আগে আমাকে একটা মিসড কল দেবে। আমি যেন দরজা খুলে রাখি। মিলি আসার পর তাকে আমার রুমে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেব। ভোররাতের দিকে সে আবার একই কায়দায় ফিরে যাবে। সন্ধ্যা থেকে ছটফট করছি কখন বাবা ঘুমাবে, কখন মিলি এসে ঢুকবে আমার রুমে।
একসময় বাবা তাঁর রুমে চলে গেলেন। আমিও লাইট অফ করে আমার রুমে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করছি আর মিলির স্বপ্ন দেখছি। কখন আসবে মিলি, কখন?
একসময় মিলির মিসড কল এল। বিড়ালের মতো নিঃশব্দে দরজা খুললাম। নির্ঝঞ্চাটে মিলি আমার রুমে এসে ঢুকল। মিলিকে জড়িয়ে ধরে মাত্র চুমু খাব, তখনই ডাইনিংস্পেসের লাইট জ্বলে উঠল। আর আমার রুমের দরজায় ধুম ধুম কিল। সঙ্গে বাবার গম্ভীর গলা, দরজা খোল বাবলু। তাড়াতাড়ি। আমি প্রথমে হতভম্ব, তারপর দিশেহারা। হায় হায়, বুঢঢা দরজা খুলতে বলছে কেন? কী হবে এখন? আমার মতো অবস্থা মিলিরও। লুকানোর জায়গাটা শেষ পর্যন্ত সে-ই বের করল। আমার খাটের তলায় গিয়ে নিঃশব্দে ঘাপটি মেরে রইল। আমি দরজা খুললাম। বাপধন ঢুকলেন। তোর রুমে কে ঢুকেছে?
বাবার সামনে আমি সব সময়ই ‘মেকুর’ হয়ে থাকি। মেকুর অর্থ বিড়াল। বিড়ালের মতো মিউমিউ করে বললাম, কে ঢুকবে? আমি তো দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে ছিলাম।
না না, ঢুকেছে। আমি টের পেয়েছি।
আমি মিউমিউ করে তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। বাবা পাত্তাই দিলেন না। প্রথমে এটাচড বাথরুম খুলে দেখলেন। কেউ নেই। আমার পড়ার টেবিলের তলা, ওয়ারড্রবের পেছন দিকটা, এমনকি ড্রয়ারগুলো পর্যন্ত খুলে দেখলেন। না, কেউ নেই। শেষ পর্যন্ত খাটের তলায় তাকালেন, আমি ততক্ষণে আর বেঁচে নেই, জিন্দা লাশ হয়ে গেছি।
আশ্চর্য ব্যাপার, খাটের তলায় বাবা মিলিকে পেলেন না। তন্নতন্ন করে অনেকক্ষণ ধরে খুঁজলেন, তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে একটা হাঁপ ছাড়লেন। না, কেউ নেই। আমার সন্দেহ হয়েছিল এ জন্য খুঁজলাম।
বাবা নির্বিকার ভঙ্গিতে বেরিয়ে যাওয়ার পর দরজা বন্ধ করে লাইট অফ করে ফিসফিসে গলায় মিলিকে ডাকলাম। বেরিয়ে এসো মিলি। এখন নো প্রবলেম।
মিলির সাড়া নেই। আমি আবার ডাকি। সাড়া নেই। আবার। না, নো সাড়া। কী ব্যাপার, খাটের তলায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ল নাকি?
লাইট জ্বেলে খাটের তলায় তাকাই, না, মিলি নেই। খাটের তলায় ঘাপটি মেরে থাকা বউটি আমার কোথায় গেল?
আমি তারপর আমার বাপধনের কায়দায় সারা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজি, বাথরুমের দরজা খুলে খুঁজি। না, মিলি নেই। মিলি কোথাও নেই।
ইমদাদুল হক মিলন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১৩, ২০০৯
Leave a Reply