আষাঢ় মাস। আকাশ ঢাকা কালো মেঘে, ভেজা বাতাস। টঙ্গীতে তুরাগের তীর ঘেঁষে সোমাদের বাড়ি। বারান্দা থেকে নদীর অস্থির নাচন দেখতে দেখতে সকালের চা খেয়েছে। এখন বেরিয়ে পড়তে হবে। ক্লাস শুরু নটায়, যদিও মন পড়ে আছে আষাঢ়ের ঘনঘটায়। কিন্তু ভাই, ডিজিটাল মেজাজের স্যার, নটা মানে নটা। এক মিনিট দেরিতে গেলে দরজা বন্ধ সব কটা।
হাতে ছাতা আর আধা ঘণ্টা সময় নিয়ে বেরোল সোমা। তার সামনে যাওয়ার দুটি পথ, আকাশ-বাস অথবা পাতালরেল। বাড়ির সামনে থেকেই উড়ান-পুল, বাস নামে কলাভবনের কোলে। ২৬ মিনিট। পাতালে গেলে টিএসসি মোড়। ১৫ মিনিট। ডিজিটাল স্যারের কথা ভেবে পাতালেই নামল সোমা। ট্রেনে বেশ ভিড়, কিন্তু বসার জায়গা পেল। ছাতাটা ভাঁজ করে ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ খুলে ই-কাগজে চোখ মেলল। খুব খারাপ একটা শিরোনাম, ‘খাদ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন’। কুষ্টিয়া কারাগারে খাবার খেয়ে এক বন্দীকে যেতে হয়েছে হাসপাতালে। ‘খাদ্যে কেন ই-কোলাই? মন্ত্রীমশাই জবাব চাই’ শিরোনামে সম্পাদকীয়টাও কড়া। মন্ত্রী এই গ্লানি মাথায় নিয়ে দিনাতিপাত করতে চান না। বন্দী যা হোক সেরে উঠেছে, মারা পড়েনি। তাহলে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকেও পদত্যাগ করতে হতো। সোমা আরও পড়ল, বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ৫-০ তে ক্রিকেট টেস্ট সিরিজ জিতেছে। এটি অবশ্য ভালো খবর। কিন্তু মিডিয়া ভীষণ খেপেছে, ক্যাপ্টেন কেন দুই খেলায় ১৯০-এর ঘরে আউট হলেন সে জন্য। ‘দলপতির লজ্জাজনক ইনিংস’ প্রহরিক ই-আলো ক্রীড়া শিরোনাম করেছে। সোমা আনন্দিত, তার প্রতিবেশী টঙ্গীবাসী সাবরিনা টেনিসে উইম্বলডন শিরোপা জিতেছে। উইম্বলডন আবার আষাঢ়ে খেলা।
ট্রেনে রবীন্দ্রসংগীত বাজছে, কিন্তু শুনছে কে! সবার কানেই ওয়াইপড। কেউ গুনগুনিয়ে বা মনে মনে গাইলেও ওয়াইপড সেটিকে পূর্ণাঙ্গ সংগীতে সাজিয়ে কানে বাজায়। অর্থাৎ কেউ অন্য কারও গান শুনছে না, নিজেদের গলায় গাওয়া নানা সব গানই শুনছে। ‘ওয়াইপডের জমানায় কে কাকে হার মানায়’ ্লোগানটা ট্রেনের গায়ে সাঁটা বিজ্ঞাপনেও আছে। সেটি দেখে সোমা হাসল।
কিন্তু কানে ওয়াইপড নেই একটি ছেলের। ২৫-২৬ বয়স। বসেছে সোমার উল্টা দিকে। ছেলেটিকে আগেও কয়েকবার দেখেছে সে। হয়তো গাজীপুর-রাজেন্দ্রপুর কোথাও থাকে। চেহারাটা মায়াময়, চোখ দুটি যেন সারা দিন মেঘে ভেসে বেড়ায়। ওই মুহূর্তে যদিও সে দুটি মেলা তার পামটপের ওপর। পামটপটি ছোট্ট, কিন্তু মহাশক্তিশালী। কে জানে, কোন সাইবার দিগন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছেলেটি। তার মনে গোপন একটা অভিলাষ জন্মালঃ ছেলেটার পাশে গিয়ে বসা চাই, কিন্তু কীভাবে?
ডানে-বাঁয়ে তাকাল সোমা। ডানে বসা লোকটাকে চেনা চেনা মনে হলো। ওহো! যোগাযোগমন্ত্রী। চোখাচোখি হতে সালাম দিল সোমা। মন্ত্রী একগাল হেসে বললেন, ‘কোনো অসুবিধা?’ সোমা বলল, ‘তেমন নয়, তবে গতকাল দুই মিনিট দেরিতে ছেড়েছে ট্রেনটি।’ মন্ত্রী বললেন, অভিযোগ পেয়ে নিজেই তদন্তে নেমেছেন। ‘দুই মিনিট! অসম্ভব!’ মন্ত্রী বললেন, ‘মানুষের সময় নিয়ে এ রকম ছিনিমিনি খেললে সহ্য করা যায়, বলুন।’
একটা স্টেশনে স্কুলের একগাদা ছেলেমেয়ে উঠল। মন্ত্রী উঠে দাঁড়িয়ে একজনকে বসতে দিলেন। সোমাও। বাচ্চারা হইচই করছে আর মায়াময় ছেলেটি মৃদু হাসছে। সোমা নিচু হয়ে বলল, ‘বাচ্চাগুলো কি কিউট, তাই না?’
ছেলেটির হাসি বন্ধ হলো। ‘কিউট একটি ইংরেজি শব্দ। এর বাংলা নেই?’ ছেলেটির পাশে কোনোক্রমে বসতে বসতে সোমা বলল, ‘আছে, মায়াময়।’
‘তাহলে বলুন, মায়াময়।’ ‘হ্যালো, মায়াময়’, সোমা বলল। এবং হাত বাড়িয়ে দিল।
সোমার হাত নিজের হাতে নিতে ছেলেটির ভেতর একটা পুলকের স্রোত বয়ে গেল। কেন, ছেলেটি জানে না। একটা মুহূর্ত তার মুখে কথা জোগাল না। কিন্তু পামটপে কিছু আলো জ্বলল-নিভল। অর্থাৎ ছেলেটির শরীরের নিউরন-টিউরনগুলোতে হুঁশিয়ারি চলে গেল, ও মিয়া, সামাল দাও। ধাতস্থ হয়ে ছেলেটি বলল, ‘ইমন’। ‘সোমা’, ইমনের হাতটা ফিরিয়ে দিতে দিতে সোমার মনে হল, হাতটা বেশ দৃঢ়, মোটেও মায়াময় নয়। কিন্তু হাতের স্পর্শে পুলক তারও কিছু কম হলো না।
ছেলেটা বলল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ স্পেস পাওয়ার প্রজেক্টে কাজ করছে। কাজটা হচ্ছে মহাকাশে ভেসে বেড়ানো বিদ্যুৎ কণা মাটিতে নামিয়ে জাতীয় গ্রিডে জোগান দেওয়া।
ছেলেটির কথাগুলোও কী বিদ্যুৎময়! সোমার মনে হলো, তার ভেতরের সবগুলো অলিন্দে-জানালায় যেন আলো জ্বলে উঠল।
‘বলুন’, সোমা তার দিকে নিবিষ্ট চোখে তাকিয়ে বলল।
মন্ত্রী নেমে যাবেন। সোমাকে বললেন, ‘কোনো সমস্যা হলে আমাকে একটা হাই-মেইল পাঠিয়ে দেবেন।’
হাই বা হাইপার মেইল হলো শুধু গ্রাহকের নাম লিখে যেকোনো টার্মিনাল থেকে ছেড়ে দেওয়া চিঠি। মন্ত্রীদের মানুষ অভিযোগ জানায় হাই-মেইলে। দিনে দুটো বা তিনটে হাই-মেইল পেলেই সাড়া পড়ে যায় সচিবালয়ে। দেশে হচ্ছেটা কী?
সোমা হেসে বলল, ‘জানাব’, কিন্তু আপাতত তার মনজুড়ে ইমন। টিএসসিতে না নেমে কার্জন হল মোড়ে নামল সোমা। ইমনের সঙ্গে আজ এনার্জি পার্কে যাবে। মাটির নিচে বিশাল দালানে চলছে বিরাট সব কাজ। ইমনের কাজের সময়ে ঢুকে পড়েছে সোমা, নিজের ক্লাসও বিসর্জন দিয়েছে। অথচ খারাপ লাগছে না কারোরই, বরং এক ফাঁকে কার্জন হলের ক্যাফেটেরিয়ায় একটা টেবিলে বসে পড়ল দুজন।
সোমার পাশের টেবিলে বসে চা খাচ্ছেন চার অধ্যাপক। দুজনকে সে চেনে, রসায়নে নোবেল পেয়েছেন। অথচ কী সাদাসিধা, যেন নোবেল কী জিনিস তা-ই বুঝতে অপারগ। তাঁদের সঙ্গে একজন ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট। যেন কত বন্ধু তাঁরা।
জানালার কাচে আষাঢ়ের আঙ্গুল। সোমার ভেতরটা ছুঁয়ে যাচ্ছে। সোমা বুঝল, কাজ ফেলে এই বসে বসে আষাঢ়ের-নাকি ইমনের-আঙ্গুলে আঙ্গুল চেপে শুধু কথা বলা আর কথা শোনা-এরই নাম ভালোবাসা।
কথাটা ইমনও বোঝে। সে হঠাৎ উঠে দাঁড়াল।
‘কাজ’, জানাল ইমন।
বাইরে তুমুল বৃষ্টি। একটা ক্যাম্পাস-বাসে উঠে এখন যাবে সে কলাভবন, ঝকমকে তকতকে রাস্তা, চারদিকে কী সবুজ, আর কী সুন্দর সব দালান, যেন সাবান ডলে তাদের গোসল দিয়েছে আষাঢ়। আকাশ- পুলে চলছে এল ট্রেন, অথচ কোনো শব্দ নেই, তাড়া নেই, কোলাহল নেই।
ছবির মতো।
সোমা বলল, কাল দেখা হবে তো?
ইমনের চোখ ভেজা। ইমন কাঁদছে কেন? সোমা খুব অবাক হলো, আবার খুব আনন্দও হলো তার। কাঁদছে কেন, সে তো জানে! কিন্তু ইমনই বলুক, কেন।
‘ইমন?’ সে জিজ্ঞেস করল।
ইমন কোনো উত্তর দিল না, শুধু হাত বাড়িয়ে সোমার একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিল। সেটি নিয়ে বুকের ডান দিকে রাখল।
ধুকপুক। একটি নয়, এক জোড়া ধুকপুকানির শব্দ। বুকের ডান দিকে।
ইমনের বুক থেকে হাত সরিয়ে মাথা নিচু করে পথে নামল সোমা। ছাতাটা ফেলে এসেছে ক্যাফেটেরিয়ায়। এখন সে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে হেঁটে যাবে কলাভবন অথবা অন্য কোথাও। অথবা তার প্রিয় স্বাধীনতা উদ্যানে।
এখন সোমাকে অনেকক্ষণ একা থাকতে হবে।
ইমনকেও। ইমনের কষ্ট, সে যদি মানুষ হতো! না, কথাটা ঠিক হলো না, ইমন অমানুষ নয়, খুবই উৎকৃষ্ট মানুষ বরং, কিন্তু হুবহু মানুষের মতো হলেও সে যে এক অ্যান্ড্রয়েড বা অ্যান্ডি। ই-মন।
সোমার বোঝা উচিত ছিল প্রথমেই। ই-মন! অ্যান্ডিদের প্রিয় নাম ই-মন। দুটো হৃৎপিণ্ড আছে বলে তাদের মনটা মানুষের মন থেকেও ভালো। উদার। কিন্তু ওই পর্যন্তই, বাকিটা সব যন্ত্রময়।
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সোমার হাসি পেল। এখন তার কোনো বন্ধু তাকে দেখলেও বলতে পারবে না, সে কাঁদছে। অথচ সে কাঁদছে, আর এই হাইপার আষাঢ়টাও কাঁদছে তার সঙ্গে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১৩, ২০০৯
Leave a Reply