বড় চাচার ঘরে ঢুকতেই দেখি, বাড়ির ছোটরা সব তাঁর ঘরে। ঘটনা কী! গল্পটল্পের ব্যাপার নেই তো? আমাকে দেখেই বড় চাচা বললেন, তুই নাকি এটাতে লিখিস, তোর নামও দেখলাম?
বড় চাচার হাতে রস+আলোর এ সপ্তাহের সংখ্যাটা। আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বললাম, লিখি মাঝে মাঝে।
– কী ছাইপাঁশ লিখিস এসব?
ছোটদের সামনে বড় চাচার এ ধরনের সরাসরি মন্তব্যে অপমানিত বোধ করার কিছু আছে কি না, সেটাই যখন ভাবছিলাম, তখনই বড় চাচা বললেন, এসব ছাইপাঁশ পড়ে এরা আবার হাসেও দেখি। আরে, এতে হাসির কী আছে? হাসির পত্রিকা বের করতাম আমি আর আমার বন্ধুরা। সে গল্প বলব বলেই তোদের ডেকেছি।
সেরেছে! যা ভেবেছিলাম, তা-ই। বানিয়ে একটা অজুহাত দিতে যাব, তার আগেই বড় চাচা শুরু করলেন, তখন আমরা সবে কলেজে উঠেছি। তোরা তো জানিসই, পড়ালেখায় আমরা সব বন্ধুই ছিলাম অসাধারণ। সবাই···
বড় চাচাকে থামিয়ে দিয়ে ঋতু বলে উঠল, এসএসসিতে তোমার কী রেজাল্ট ছিল, বড় চাচ্চু?
-আরে, সে তো আরেক ঘটনা। আমি, মশিউর···
বড় চাচা আরেক গল্প ফাঁদতে যাচ্ছেন বুঝতে পেরে বাধা দিই আমি, থাক, এটা পরে শুনব, তুমি আগে ওটা শেষ করো। বড় চাচা আবার শুরু করেন, তো আমরা কলেজে ভর্তি হওয়ার ছয় মাস যেতে না যেতেই লক্ষ করলাম, কলেজের দুই বছরের বই-ই আমাদের মুখস্থ হয়ে গেছে। পড়ার আর কিছুই নেই! আমরা তখন কী করি? কিচ্ছু ভাল্লাগে না। তখন মশিউর বলল, আয়, একটা ফান ম্যাগাজিন বের করি। সঙ্গে সঙ্গে আমরা আনন্দে ইউরেকা ইউরেকা বলে পুরো কলেজে একটা চক্কর দিয়ে দিলাম। সেই ‘ইউরেকা’ই হলো পত্রিকার নাম। তারপর থেকেই মনে হয়, মানুষ হঠাৎ কিছু পেয়ে গেলে ‘ইউরেকা’ বলে!
বড় চাচা বলে চলছেন, প্রথম সংখ্যাতেই তাক লাগিয়ে দিলাম। যে পড়ে সে-ই হাসে। যখন পড়ে তখন তো হাসেই, যখন পড়ে না, তখনো হাসে। একদিন মকবুল স্যার ক্লাস নিচ্ছেন। তিনি নিউটনের তৃতীয় সূত্রটা বলতেই আমিনুলটা হো হো করে হেসে উঠল। স্যার রেগে গিয়ে বললেন, নিউটনের এ সূত্রের কোন জায়গাটি হাসির, আমাকে বুঝিয়ে বল। কে শোনে স্যারের কথা, আমিনুল তখনো হেসেই চলেছে। স্যার ওকে মারতে যাবেন, এমন সময় ও হাসতে হাসতেই কোনোমতে বলল, তিন দিন আগে নাকি ও আমাদের পত্রিকার একটা লেখা পড়েছিল, সেটা মনে পড়েছে বলেই হাসছে! স্যার এবার আমাদের মারতে এলেন। বললেন, পত্রিকা বের করে ছেলেপেলেদের মাথা খাচ্ছ? দেখাচ্ছি মজা। আমি তখনই বুদ্ধি করে ব্যাগ থেকে আমাদের পত্রিকাটা বের করে দিলাম। প্রচ্ছদ দেখেই স্যারের সে কী হাসি! মজার ব্যাপার হলো, সপ্তাহ খানেক পর স্যার যখন আলোর প্রতিসরণ পড়াচ্ছিলেন, তখন নিজেই হেসে উঠলেন। তাঁর নাকি আমাদের পত্রিকার একটা কার্টুনের কথা মনে পড়েছে।···
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি কে জানে। সজাগ হতেই দেখি, চাচার গল্প প্রায় শেষ। ছোটরা একেকজন একেক প্রশ্ন করছে। আমিও কিছু একটা না জিজ্ঞেস করলে খারাপ দেখায়। তাই বুদ্ধি করে জানতে চাইলাম, বড় চাচা, তোমার পত্রিকাটা তো এখন আর বের হয় না। তা এটা বন্ধ হলো কেন?
বড় চাচা ফিসফিস করে বললেন, কাউকে বলিস না যেন! আমাদের পত্রিকা পড়ে মানুষজন হাসত, রাস্তাঘাটে গড়াগড়ি খেত, তাতে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু একবার আমাদের পত্রিকা পড়ে একজনের হাসতে হাসতে পেট ফেটে গেল! তারপর আরও দুজনের একই অবস্থা। তারপর আরও অনেকের। এই যে লোকে বলে না, ‘হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাওয়া’-এ কথা তো এ ঘটনার পরই সৃষ্টি হয়েছে! এ রকম চলতে থাকলে তো আমাদের পুলিশে ধরত, ঠিক ফাঁসি হয়ে যেত। তাই গোপনে ওটা বন্ধ করে দিলাম। আর সব কপিও পুড়িয়ে ফেললাম, নয়তো আবারও যদি কারও হাসতে হাসতে পেট ফেটে যায়!
রাতে ঘুমানোর আগে হঠাৎ বড় চাচার ঘর থেকে তাঁর হাসির শব্দ শুনলাম। ব্যাপারটা কী জানতে জানালা দিয়ে তাঁর ঘরে উঁকি দিতেই দেখি, বিছানায় শুয়ে শুয়ে তিনি রস+আলো পড়ছেন!
মহিতুল আলম
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১৩, ২০০৯
Leave a Reply