মাইকেল জ্যাকসনের ওই গানটা শুনেছিস-‘আই শ্যাল নট লেট ইউ গো চোটা মামা?’
শুনিনি।
শোনার কথা নয়। এটা এক্সক্লুসিভলি আমাকে নিয়ে গাওয়া। কোনো অ্যালবামে যায়নি। আমি যখন ইন্ডিয়ানা থেকে চলে আসি, মানে যখন আমাকে ইন্ডিয়ানা থেকে প্যাক করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়, তখন কেঁদে কেঁদে ওই গানটা গেয়েছিল-ছোট মামা, আমি তোমাকে যেতে দেব না।
উপমা একটুখানি কেশে বলল, ছোট মামা, তোমার আষাঢ়ে রোগটা পুরো সারেনি?
ছোট মামা গেয়ে উঠল, আষাঢ়-শ্রাবণ মানে নাকো মন, ঝরঝর ঝরঝর ঝরিছে।
ছোট মামা মানে কী? ছোটদের মামা, না মামাদের মধ্যে ছোট? যেটাই হোক তাঁর পরিচিতি ছোট মামা হিসেবে। থানার ওসি ডাকে ছোট মামা, সংস্কৃতিমন্ত্রীও ডাকে ছোট মামা, মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলে চোটা মামা।
পড়াশোনা করতেই তার ইন্ডিয়ানা যাওয়া, কিন্তু লেখাপড়া করে নষ্ট করার মতো সময় তার কোথায়? তার প্যাশন হচ্ছে গান। ফ্রাঙ্ক সিনাত্রার ছবিঅলা টি-শার্ট আর কার-বুট সেল থেকে কেনা গিটার-দেখলেই চেনা যায় এই হচ্ছে ছোট মামা। ভূগর্ভে মেট্রো স্টেশনে সিনাত্রার গান গেয়ে দু-চার ডলার কামিয়েছে সত্য, কিন্তু টার্গেট থেকে সরে আসেনি। কনভেনশন হলে গাইতে হবে।
জায়গাটাতে বর্ণবাদীদের আসর। কালো রঙের শিল্পীরা স্টেজে উঠতে পারে না।
‘কী করেছি শোন, শরীরের ওপরের দিকটা, শুদ্ধ বাংলায় যাকে চলে ঊর্ধ্বাঙ্গ, পুরোদস্তুর চুনকাম করিয়ে নিলাম। নিচের অংশ প্যান্ট ও জুতো-মোজার ভেতরেই থাকে, সমস্যা নেই। পুরোনো দিনের ইংরেজি গান গেয়ে কনভেনশন সেন্টার মাতিয়ে দিলাম। অডিয়েন্স থেকে কেবল ভেসে আসছে, ওয়ান মোর চোটা মামা।’
‘দর্শকদের মধ্যে পুলিশও ছিল। পুলিশ গান শুনতে পারবে না এমন কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। বিবিসি, এনবিসি, সিএনএন···ইন্টারভিউ শেষ করতেই পুলিশ বলল, স্যার, আর একটা ইন্টারভিউ। তখন আমার হাতে মাইকেলের অটোগ্রাফ খাতা, সই করা হয়নি। খাতাসুদ্ধ নিয়ে এল পুলিশ স্টেশনে। শুদ্ধ বাংলায় মানবদেহের যে অবস্থাকে তোরা বলিস দিগম্বর, আমাকে ঠিক তা-ই করা হলো। আমাকে ইন্টারোগেট করতে এসেছেন বড় সাহেব। তাঁর স্যুট, ওভারকোট, মাফলার ও হ্যাট দেখে আমার লজ্জা পাওয়ার অবস্থা।’ তিনি বললেন, ‘লজ্জা কিসের? তোমাদের মিস্টার গান্ধীও প্রায় দিগম্বরই থাকতেন।’
আমরা গান্ধী পাব কোথায়? তিনি বললেন, সত্যি কথা বলো, ওপরের দিকটা সাদা আর নিচের দিকটা কালো হলো কেমন করে? কোনটা জেনুইন?
ছোট মামা এত সহজ প্রশ্নে ঘাবড়ানোর লোক নয়। পটাপট বলে দিল, ‘আমার গ্র্যান্ডমা হোয়াইট লেডি আর গ্র্যান্ডপা বেঙ্গল ব্ল্যাকম্যান। এটা জিন ক্রোমোজোমের ব্যাপার। তুমি যত বড় পুলিশই হও না কেন, বুঝবে না। কম্বিনেশনের সময় গ্র্যান্ড মার হোয়াইট রংটা লেগেছে আমার ঊর্ধ্বাঙ্গে আর দাদুর কালোটা নিচে।
পুলিশ সাহেব বললেন, মোস্ট ইউনিক জেনেটিক কম্বিনেশন। যা হোক, তোমাকে আমরা চোখে চোখে রাখব-মানে আন্ডার ওয়াচ। জ্যাকসন ফ্যামিলি তোমাকে তাদের জিম্মায় নিতে চাইছে। গ্র্যান্টেড।
থানা থেকে ছোট মামাকে ছাড়িয়ে নিল জোসেফ ও ক্যাথেরিন জ্যাকসন। তাদের নয় সন্তানের পাঁচজন ‘দ্য জ্যাকসন ফাইভ’-জ্যাকি, টিটো, জার্মেইন, মার্লোন ও মাইকেলও এসেছে।
‘বুঝলি, টেনেহিঁচড়ে বাসায় নিয়ে গেল। ছোট বাসা, মানুষ ১১ জন। ক্যাথেরিন বলল, ১১ জনের যখন জায়গা হচ্ছে, ১২ জনেরও হবে। আমার স্বামীর ইচ্ছে, তুমি আমার বাচ্চাদের, বিশেষ করে মাইকেলকে ক্লাসিক্যালটা একটু ধরিয়ে দাও। তোমার থাকা-খাওয়ার চিন্তা আমাদের।’
মাইকেল ছোট মামার গলা জাপটে ধরে চুমু খেতে খেতে বলল, ‘গট দ্য আইডিয়া চোটা মামা। কী করতে হবে বুঝে গেছি। অর্ধেকটা নয়, পুরোটাই ব্লিচিং করে সাদা বানিয়ে ফেলতে হবে।’
‘বুঝলি, এভাবেই কালো ছেলেটা সাদা হয়ে গেল। হোয়াইটদের ধোঁকা দেওয়ার অপরাধে আমার ডিপোর্টেশন অর্ডার হয়। তত দিনে আমি মাইকেলের মনে বঙ্গ-সংস্কৃতির বীজ বুনে দিয়েছি। ওই গানটা শুনিসনি-দ্য ওয়ে ইউ মেক মি ফিল-রূপে আমার আগুন জ্বলে যৌবন ভরা অঙ্গে কিংবা লম্বা সাদা মোজা পা আর দস্তানায় হাত ঢেকে নাচার সময় একটু পর পর নাজুক অঙ্গ চেপে ধরা-এর মানে মাইনকা চিপায় পড়ছিরে ভাই কেয়ারটেকার সরকার নিয়া।
মন খারাপ ছোট মামার। আষাঢ় মাসের ১১ তারিখে মাইকেল জ্যাকসন বিদায় নিল।
ছোট মামা বলল, এবার আমার পালা। রোগের প্রকোপটা বেড়ে যাচ্ছে।
আন্দালিব রাশদী
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১৩, ২০০৯
Leave a Reply