নিশ্চিন্তপুর রাজ্যে একবার আষাঢ়ে গল্পের বিরাট প্রতিযোগিতা হয়েছিল। আজকাল বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে যেমন তারকা, তারকাদের তারকা, তিন চাকার তারকা, দুই হাঁড়ির তারকা-এ রকম বিভিন্ন প্রতিযোগিতা হয়, সেকালে এসব হতো রাজসভায়।
তো, আষাঢ় মাসের এক সন্ধ্যায় ল্যাংড়া আমের আঁটি চুষতে চুষতে হবুচন্দ্র রাজা ভাবলেন, একটা আষাঢ়ে গল্পের প্রতিযোগিতা করলে কেমন হয়।
যেমন ভাবা তেমন কাজ, দুই দিনেই আষাঢ়ে গল্পের তারকাদের তারকা নির্বাচনের ‘তোমাকেই খুঁজছে রাজসভা’ পোস্টার, লিফলেটে রাজ্য ছেয়ে গেল।
পাছে নির্বাচনে কোনো ভুল হয়, রাজা তাই এ গুরুদায়িত্ব অন্য কাউকে দিতে রাজি হলেন না। রাজা নিজে হলেন বিচারক, মন্ত্রী আর কোতোয়াল হলেন সহবিচারক। প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত প্রতিযোগিতা চলল। দুনিয়ার যেখানে যত চাপাবাজ ছিল তারা এসে একে একে গল্প শোনাতে লাগল। রাজার কোনোটাই পছন্দ হয় না। কোনো গল্পের শুরুটা সত্যের মতো লাগে, কোনো গল্পের শেষটা মনে হয় হলেও হতে পারে।
রাজা ত্যক্তবিরক্ত। রাজার বিরক্তি যত বাড়ে, সেই সঙ্গে মন্ত্রীর মুখও শুকায়। হায় হায় কী উপায়! সত্যিকার আষাঢ়ে গল্প কি আর পাওয়াই যাবে না এবার বর্ষায়!
এ রকম একদিন এক চিমসেমুখো মানুষ এসে হাজির হলো রাজসভায়। তার নাম তোতা মিয়া। প্রতিযোগিতা তখন প্রায় শেষ হয়ে গেছে, আগামীকাল থেকেই শুরু হবে শ্রাবণ মাস। শ্রাবণ মাসে তো আর আষাঢ়ে গল্প বলার কোনো সুযোগ নেই। গবুচন্দ্র মন্ত্রী ভাবলেন, কত হাতিঘোড়া গেল তল, তোতা পাখি বলে কত জল! আচ্ছা, এসেছেই যখন, তখন তার আষাঢ়ে গল্পটাও না হয় শোনা যাক। তোতা মিয়াকে হাজির করা হলো রাজার সামনে।
তোতা মিয়া বলল, ওয়ান্স আপন এ টাইম, মানে কোনো এককালে কোনো একটা দেশ ছিল। সেই দেশে রাজা ছিল না, তবে গন্ডা গন্ডা মন্ত্রী ছিল।
হবুচন্দ্র রাজা গবুচন্দ্র মন্ত্রীর দিকে তাকালেন। এ কেমন দেশ, যেখানে ভূরি ভূরি মন্ত্রী আছে, কিন্তু রাজা নেই! এমন দেশ হয় নাকি আবার! বেশ একটা আষাঢ়ে গল্পের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে তাহলে। রাজা বললেন, তারপর?
তোতা মিয়া, সেই দেশটা ছিল নদীমাতৃক, মানে তাদের দেশে অনেক নদী। তবে দেশের লোকজন সেখানে নদীর ওপর কোনো সেতু তৈরি করত না। তারা রাস্তা কেটে সেখানে সেতু তৈরি করত!
হবুচন্দ্র মুচকি হেসে বললেন, বেড়ে বলেছ তো হে! রাস্তা কেটে নদী তৈরি করত!
তোতা মিয়া বলল, জি হুজুর। তারা যে শুধু রাস্তা কেটে নদী তৈরি করত এমন না, ধানি জমির ওপর, গোচারণ ভূমির ওপর, এমনকি বড় বড় নেতার বাড়ির উঠোনে পর্যন্ত সেতু তৈরি করত! এই সেতুগুলোর সংখ্যা এত বেশি হয়ে গিয়েছিল যে দেশের সবচেয়ে বড় পত্রিকা একবার এই সেতুগুলোর ছবি দিয়েই পুরো এক দিনের সংখ্যা নামিয়ে ফেলেছিল।
রাজার হাসি আর ধরে না। এতক্ষণে পাওয়া গেছে এক আসল গল্পকার।
রাজা কৌতূহল নিয়ে বললেন, এত অনাচার, সেগুলো দেখার জন্য কেউ ছিল না? দেশ চালাত কারা?
তোতা মিয়া বলল, সেই দেশ চালাতে হলে আগে অনেক কালো টাকার মালিক হতে হয়। তারপর ধরেন, যার যত বেশি মামলা, যে যত বেশি অনাচার করেছে, সে-ই বেশি ভোটে দাঁড়াত।
রাজা বললেন, বলো কী হে! কেন, ওই দেশে পাইক-পেয়াদা ছিল না? কাজির দরবার ছিল না? সেখানে বিচার হতো না?
তোতা মিয়া বলল, পাইক-পেয়াদা ছিল হুজুর। তবে তারা কাজির ধার ধারত না। নিজেরাই চোর-ডাকাত, গুন্ডা-বদমাশ ধরত। ধরার পর তাদের নিয়ে গভীর রাতে অস্ত্র উদ্ধারেও যেত।
গবুচন্দ্র মন্ত্রী বললেন, অস্ত্র খুঁজে পাওয়া যেত অন্ধকারে?
তা পাওয়া যেত মাঝেমধ্যে। কিন্তু মজার বিষয় হলো, যত গোপনেই অস্ত্র উদ্ধারে যাক না কেন, কীভাবে কীভাবে যেন তাদের সঙ্গী-সাথিরা খবর পেয়ে যেত, তারা আক্রমণ করত পাইক-পেয়াদাকে। এ সময় কখনোই আর কোনো সঙ্গী-সাথির কিছু হতো না, কিন্তু আক্রমণ করামাত্রই গ্রেপ্তার হওয়া লোকটি টপ করে গুলির সামনে পড়ে মরে যেত। যতজনকে নিয়েই অস্ত্র উদ্ধারে যেত, প্রতিবার একই ঘটনা।-তোতা মিয়া বলল।
প্রতিবার!-রাজার বি্নয় বাঁধ মানে না।
তোতা মিয়া বলে, জি, প্রতিবার।
গবুচন্দ্র মন্ত্রী প্রশ্ন করলেন, তা, শুধু কি অস্ত্রপাতি উদ্ধার হতো? চুরি-বাটপারির টাকা উদ্ধার হতো না?
তোতা মিয়া হেসে বলল, চুরি-বাটপারির টাকা তো সেই দেশে বৈধ ছিল। কেউ যদি সৎ পথে টাকা রোজগার করত, তাহলে তাকে অনেক টাকা আয়কর দিতে হতো! কিন্তু ঘুষ, চুরি-বাটপারি, এগুলোর জন্য এত টাকা দিতে হতো না।
রাজা বললেন, নিশ্চয়ই সেই টাকা বাজেয়াপ্ত করা হতো।
তোতা মিয়া জবাব দিল, না হুজুর, সেই দেশে অবৈধ টাকা থাকলে অল্প কিছু টাকা সরকারকে দিলেই সরকার আর ওই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করত না। সৎ পথে রোজগার করলে বেশি টাকা দিতে হতো, কিন্তু কালো টাকা রোজগার করলে কম টাকা দিলেই চলত।
রাজা গল্পে মজা পেয়ে গেলেন। তিনি জানতে চাইলেন, কিন্তু এভাবে একটা রাজ্য তো চলতে পারে না! সবাই যদি চুরিধারি করতে থাকে, তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে উঠবে! ব্যবসা বাণিজ্য চলে না সে রাজ্যে?
তোতা মিয়া মাথা চুলকে বলল, তা নিশ্চয়ই চলে, হুজুর। ধরেন, যার ব্যবসা সবচেয়ে ফেল, সেই বেশি ব্যবসা করে।
গবুচন্দ্র বললেন, সেটা কীভাবে সম্ভব?
সেটাই হয় হুজুর! যেমন ধরেন, একজন লোক, তার ব্যবসা-বাণিজ্য চলে না; সে ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে ব্যবসা করে, ব্যবসা চলে না বলে সে ব্যাংকের টাকা দেয় না-এভাবে না দিতে দিতে সে রাজ্যের সবচেয়ে বড় ফেলমার্কা ব্যবসায়ী হয়ে গেল। ব্যাংক থেকে টাকা নেওয়া দশটা ব্যবসার মধ্যে তার আছে চারটা; সেই লোককে প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব দিতেন বেসরকারি খাত উন্নয়নের উপদেশ দেওয়ার জন্য।
তোতা মিয়া আরও কী কী যেন বলতে চাইছিল। কিন্তু তখন আষাঢ়ের শেষ প্রহর, আষাঢ়ে গল্প শেষ না করলে শ্রাবণী গল্প হয়ে যাবে।
কিন্তু রাজা খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে তোতা মিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর রাজসভা কাঁপিয়ে হাসতে থাকলেন। আষাঢ়ে গল্প বলেছে বটে, পুরো একটা রাজ্য নিয়ে আষাঢ়ে গল্প। রাজা আশপাশে তাকিয়ে বললেন, তোতা মিয়া, আর বলতে হবে না, সময় শেষ। তবে এ রকম উল্টাপাল্টা রাজ্যের গল্প কেউ কোনো দিন কল্পনাও করতে পারবে না, তোমারটা পুরো আষাঢ়ে গল্প হয়েছে।
ওরে, কে আছিস, তোতা মিয়াকে প্রথম পুরস্কারটা দিয়ে দে। এর চেয়ে আজগুবি গল্প আর কেউ শোনাতে পারবে না।
গবুচন্দ্র মন্ত্রী তখন মনে মনে ভাবলেন, ভাগ্যিস, এমন কোনো উল্টাপাল্টা রাজ্য নেই, পুরোটাই আষাঢ়ে গল্প। তিনিও ফিক করে হেসে পুরস্কার আনতে ছুটলেন।
আরিফ জেবতিক
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১৩, ২০০৯
Leave a Reply