এক ছিলেন পণ্ডিত। ওই দূরের এক গাঁয়ে তাঁর বাড়ি। একদিন তিনি মাঠ পেরিয়ে ঘরে ফিরছিলেন। এমন সময় হঠাৎ বিষম এক কাশি এল। আর মুখের ভেতর থুতুর সঙ্গে কী একটা অস্বস্তিকর জিনিসের অস্তিত্ব যেন টের পেলেন সেই পণ্ডিত। ওয়াক থু করে থুতু ফেলতেই মুখ থেকে পড়ল পাখির ছোট এক পালক।
পণ্ডিত অবাক হলেন। ভাবলেন এ কী কাণ্ড! তিনি তো পাখির মাংস খাওয়া দূরে থাক, পাখি নেড়েও দেখেননি। ভারি ভাবনায় পড়লেন তিনি। ধুতির খুঁটে সেই পালক বেঁধে একরাশ দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগ নিয়ে বাড়ি ফিরলেন বামুন পণ্ডিত। বাড়ি ফিরে ধপ করে একটা জলচৌকিতে বসে মুখ আঁধার করে ভাবতে লাগলেন। বউ কাছে এসে বললেন, হ্যাঁগো, তোমার হয়েছে কী? অমন থুবড়ো মুখ করে বসে পড়লে যে!
বামুন মুখটা আমসি করে বললেন, হয়েছে এক মহাভজকট। কাউকে বলবে না, এ শর্তে কথাটা ভাঙতে পারি। বামুন পণ্ডিতের বউ বলেন, তুমি হলে স্বামী দেবতা। তুমি বারণ করছ, তার পরও আমি গোপন কথা দুই কান করব-এমনটা ভাবতে পারলে? বামুন পণ্ডিত ধুতির খুঁটি থেকে পাখির পালক বের করে বউয়ের হাতে দেন।
বামনি পালকটা দেখে বলেন, মিনসের কাণ্ড দেখ না। মাঝেমধ্যে ধুতির খুঁটি খুলে পয়সাকড়ি দেয়, আজ দিচ্ছে কি না একটা পাখির পালক! বুড়া-হাবড়ার এ আবার কোন ঢং! পণ্ডিত বললেন, না বউ, মশকরা নয়। বিষয়টা বড়ই উদ্ভট, তাই খুব চিন্তায় পড়েছি। এই বলে বউকে ঘটনাটা খুলে বলেন। আর দিব্যি করায়, খবরদার কাউকে এ ঘটনা বলবে না কিন্তু! বউ বলে, পাগল হয়েছ, ঘরের কথা পরের কাছে বলব!
কিছুক্ষণ পরে বউ গেছে পুকুরে জল আনতে। সেখানে দেখা নীরুবালার সঙ্গে। নীরুবালা পণ্ডিতদের পড়শি। বামনি এ কথা-সে কথা বলে কিন্তু পেটের ভুটভাট যায় না। খালি গোপন কথাটা বেরিয়ে আসতে চায়। শেষে আর কৌতূহল দমন করতে না পেরে বলে, অই নীরু, তুই আমার সই। তোকে কোনো কথা না বলে পারি না। আজ একটা বড়ই গোপন কথা আছে, কাউকে বলবি না বল, তাহলে তোকে বলি।
নীরু বলে, বামনি দিদি! তোমার সই নীরুর পেট একখানা সিন্দুক। কোনো কথা সেখানে পড়লে তা আর বের হয় না। তো, বামনি তাকে তার স্বামীর থুতু আর পাখির পালকের বৃত্তান্ত সবিস্তারে বলে।
নীরুবালা আশ্বাস দিয়ে এবং এটা কোনো অলক্ষুণে ব্যাপার নয়, এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করে বিদায় নেয়।
রাস্তায় যেতে যেতে নীরুর দেখা হয় মোল্লাগিন্নি হাশমতির সঙ্গে। হাশমতি অন্য সম্প্রদায়ের, তবে দিলখোলা মিশুক। এ গাঁয়ে হিন্দু-মুসলমান মিলঝিলও বেশ। নীরু বলে, দিদি একটা কথা, কিন্তু বড়ই গোপন। কাউকে না বললে তোমাকে বলতে পারি। তোমার সোয়ামিকেও বলা যাবে না। ভগবানের কিরে, বলবা না কিন্তু।
হাশমতি বলে, দিদিলো, পুকুরঘাটে কত কথাই তো হয়। কোনো দিন হুনচ, হাশমতি কথা লাগাইয়া-পারাইয়া বেড়ায়? আল্লা-রসুলের কছম, কথা গোপন থাকব। এই প্রতিজ্ঞা করার পর নীরু বলে, শুনছ আজ কী হয়েছে? পণ্ডিতের বউয়ের কাছে মাত্রই শুনলাম, পণ্ডিত মাঠের মধ্য দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় তার মুখের ভেতর থেকে একটা মস্ত পাখি বেরিয়ে উড়াল দিয়ে চলে গেছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে গোটা গ্রামবাসী জানল পণ্ডিতের মুখ থেকে একটার পর একটা পেল্লায় পাখি বের হচ্ছে, আর উড়ে যাচ্ছে। নানা রঙের পাখি, নানা দেশের। সে এক অলৌকিক ঘটনা বটে!
— শামসুজ্জামান খান সম্পাদিত গ্রামবাংলার রঙ্গ রসের গল্প থেকে সংগৃহীত।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ২৯, ২০০৯
Leave a Reply