শিরোনামের কথাটা ধার করা। বলেছিলেন শেক্সপিয়র মহাশয়। ভুল বলেছিলেন! কতটা ভুল বলেছিলেন, সেটা তিনি নিজেই বুঝতেন, যদি কেউ তাঁর নামের বানানে একটু গড়বড় করে ‘শ’-এর বদলে ‘স’ দিয়ে শুরু করত। কী বিচ্ছিরি কাণ্ডটাই না হতো!
নাম যে কত ‘বড়’ একটা ব্যাপার, এ ধারণা আমি স্কুলজীবনেই পেয়েছিলাম। নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় শিক্ষা বোর্ডের পাঠানো ওএমআর ফরম পূরণ করতে হতো। সেই ফরম পূরণ করতে গিয়েই বাধল বিপত্তি। আমাদের এক সহপাঠীর নাম-পাঠক, একটা লম্বা দম নিন-আবুল কাশেম মোহাম্মদ হেদায়েতুল বারি বিন রকিবুল হাসান রকেট। এত লম্বা নাম তো পূরণ করার কায়দা নেই। এতগুলো ঘরই নেই ফরমে। এ নিয়ে উত্তেজনা উঠল চরমে। স্যাররা বললেন, ‘রকেট বাবা, তুমি তোমার নাম ছোট করো।’ তার অভিভাবকদের ডাকা হলো। রকেটের দাদা প্রধান শিক্ষকের টেবিলে বাড়ি মেরে হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘নাম ছোট করব মানে! প্রশ্নই আসে না। নাতির নাম আমি আট-আটটা খাসি কোরবানি দিয়ে রেখেছি।’ আমরা এই ভেবে স্বস্তি পেলাম, ভাগ্যিস খাসির সংখ্যা এক ডজন ছিল না!
ওই সমস্যার সমাধান কীভাবে হয়েছিল, সেটা আজ আর মনে নেই। তবে এতটুকু মনে আছে, বন্ধু মহলে রকেট তার প্রকৃত নামটার অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারেনি। সেটা কেউই পারে না। বন্ধুরা নিজস্ব রীতিতে নতুন নামকরণ করে। ওটাই রেওয়াজ। বিশেষ করে যদি একই ব্যাচে একাধিক বন্ধুর নাম একই থাকে।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাটাই বলি। স্কুলে আমাদের ক্লাসেই ছিল চারজন রাজীব! দ্বিপদ নামকরণ অনুসারে তাই শেষ পর্যন্ত কেউ আর কেবল পিতৃ প্রদত্ত নাম নিয়ে শান্তিতে থাকতে পারিনি। আসল নামের সঙ্গে জুড়ে গেছে লেজ। কেউ হয়ে গেছে ‘গুড় রাজীব’ (কথিত আছে, তার দাদা নাকি একসময় গুড় বিক্রি করতেন)। ষণ্ডা প্রকৃতির যে ছিল, তাকে ডাকা হতো ‘ক্ষুর রাজীব’ (না, এর দাদা-নানা কেউ নাপিত ছিলেন না। ক্ষুর দিয়ে ক্ষৌরকর্মের পাশাপাশি আরও অনেক কিছুই তো করা যায়, নাকি?)। সুবোধ বালকটির নাম হয়ে গিয়েছিল সোনামণি রাজীব। আর আমার? বলব না, যাহ্ লজ্জা লাগে!
এত এত রাজীব নামকরণের পেছনে ভারতের রাজীব গান্ধী পরোক্ষভাবে কোনো ভূমিকা রেখেছেন কি না আমি জানি না। তবে শৈশবে এটা নিশ্চিত জানতাম, ‘গান্ধী’ উপাধিটি খুব একটা সুখকর কিছু নয়। ভারতের জাতির জনকের খবর তখনো আমার কাছে পৌঁছায়নি। আর তাই কেউ আমাকে, তা সে আদর করেই হোক না কেন, ‘গান্ধী’ বলে ডাকলে গর্ব করার বদলে গন্ধ ছড়ানো একটা পোকার কথাই মনে পড়ে যেত!
স্কুল ছেড়েছি সেই কবে। কিন্তু নামবিভ্রাট এখনো পিছু ছাড়েনি। সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা তো এই সাংবাদিক জীবনেই পেতে হলো। সম্প্রতি আমাদের প্রথম আলোয় এসে যোগ দিয়েছেন নতুন সহকর্মী। তাঁর নামও রাজীব। এবং কী কান্নার ব্যাপার, তাঁর নামের শেষেও ‘হাসান’। আ-কার ই-কার সব মিলে যায়। দুজন দেখতেও গড়নে-চলনে প্রায় একই রকম! হররোজ নামবিভ্রাটে পড়তে হচ্ছে। হয়তো দেখা গেল জরুরি কোনো লেখা লিখছি, মাঝপথে অভ্যর্থনা থেকে ফোনঃ ‘রাজীব ভাই আপনার গেস্ট।’ এমনিতে ক্রীড়া বিভাগ থেকে অভ্যর্থনা কক্ষ পর্যন্ত আসতে আমার মতো হাড়-আলসের জান কাবার হয়ে যায়। তো বহু ক্রোশ পাড়ি দিয়ে গেস্ট রুমে এসে, অপরিচিত অতিথির সঙ্গে মিনিট দশেক আলাপ-আলোচনা করে, গোটা তিনেক চা খাইয়ে বোঝা গেল, অতিথি আমার কাছে নয়, এসেছেন অন্য রাজীবের কাছে!
স্কুলজীবনে আরেকটা নাম ‘কমন’ ছিল-স্বপন। সে ক্ষেত্রে নামকরণটা প্রধানত হতো শারীরিক আকৃতি দিয়ে। কারও নাম বাইট্টা স্বপন, কেউ লম্বু স্বপন, কেউ মোটকু, কেউ চিকনা, কেউবা হয়ে গেল দাঁতু স্বপন। একজন ছিল ব্যতিক্রম। যার নামকরণ করা হলো ভুয়া স্বপন! কেন? বেচারার চাপায় চর্বি একটু বেশি ছিল। আর সেই চর্বি গলাতে হররোজ চাপা মেরে যেত। ফলে ওর কোনো কথাই আমরা বিশ্বাস করতাম না।
বন্ধুদের দেওয়া নাম নিয়ে কারও খুশি হওয়ার মতো ঘটনা ঘটে না। কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে এই নামগুলোকে অস্বীকার করারও আর কোনো উপায় থাকে না। এই তো সেদিন মোবাইল ফোনে অচেনা নম্বর থেকে একটা ফোন এল। ‘হ্যালো, কে বলছেন?’ ‘দোস্ত, আমি স্বপন।’ ‘কোন স্বপন?’ ‘ইয়ে···ভুয়া, ভুয়া স্বপন!’
শুধু কি বন্ধুরা নাম পাল্টায়? বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় দেখেছি, অনেকেই সেকেন্ড ইয়ারে উঠতে না উঠতেই বেশ-ভূষা, চলন-চালন, কথা বলার ভঙ্গি, চুলের ছাঁট আর ভ্রূর আকার পাল্টানোর পাশাপাশি নামটাও পাল্টে ফেলে। রোজিনা হয়ে যায় রোজ, মোকসেদ হয়ে যায় ম্যাক। সাহিত্যিক সমাজেও এই চল আছে বৈকি। পিতামহের একাধিক খাসি কোরবানির কথা হাসিমুখে ভুলে গিয়ে অনেকেই নাম রাখেন রাশভারী। অখ্যাত এক কবিকে চিনি, যিনি আদিত্য উলফাত নামে লেখেন। সন্দেহ করি, তাঁর আসল নাম আবেদ মিয়া। হয়তো রইস উদ্দিন হয়ে যায় রাশা রাসপুটিন।
মাঝেমধ্যে অবশ্য শেক্সপিয়ারের কথাটাও সত্যি বলে মনে হয়। আসলেই তো, নামে কী বা আসে-যায়? দেখবেন, ভীরু-কাপুরুষ কারও নাম বিপ্লব কিংবা পাড়ার দাপুটে মাস্তানটার নাম শান্ত। হায়রে কপাল, এফএম রেডিওতে অনর্গল কথা বলে যাওয়া উপস্থাপকের নাম কিনা নীরব!
রাজীব হাসান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ২৯, ২০০৯
Leave a Reply