সিঁধেল চোরটা টপ করে জানালার ভেতরে ঢুকে পড়ল, তারপর সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে লাগল। সুদক্ষ সিঁধেল চোররা কখনো তাড়াহুড়া করে না।
চোরটা একটা সিগারেট ধরাল।
মুখোশ পরেনি সে, পায়ে রবারের জুতাও নেই। খালি একটা ৩৮ ক্যালিবারের রিভলবার তার পকেটে।
খুব বড় কিছু চুরি করার আশায় আসেনি সে। আইনত যেটুকু তার ব্যবসার পক্ষে লাভজনক, তার বেশি আর সে কিছু স্পর্শ করবে না। সে দেখতে পেল জানালাটা খোলাই রয়েছে। এ সুযোগ সে গ্রহণ করল।
বাড়ির মালিক বিছানায় ঘুমিয়ে ছিলেন। ড্রেসিংটেবিলের ওপরে অনেক জিনিস এলোপাতাড়ি ছড়ানো। চোরটি ড্রেসিংটেবিলের দিকে তিন পা এগিয়েছে, এমন সময় ভদ্রলোক একটা গোঙানির শব্দ করে চোখ খুললেন। তিনি তাঁর ডান হাতটা বালিশের তলায় ঢোকালেন কিন্তু বের করার সময় পেলেন না।
চোরটি কথা বলার ভঙ্গিতে বলল, ‘নড়বেন না।’ প্রথম শ্রেণীর চোরদের মতো তৃতীয় শ্রেণীর সিঁধেল চোররা ‘হিস’ শব্দ করে চুপ করায় না; বিছানায় শোয়া ভদ্রলোকটি চোরের রিভলবারের গোল মাথাটার দিকে চেয়ে যেমন ছিলেন তেমনিই রইলেন।
চোর হুকুম করল, ‘হাত উঁচু করুন।’
বিরক্ত মুখে ভদ্রলোকটি বিছানায় উঠে বসে তাঁর ডান হাতটা মাথার ওপরে তুললেন।
চোর হুকুম করল, ‘অন্য হাতটাও তুলুন।’
ভদ্রলোক মুখটা বিকৃত করে বললেন, ‘ও হাতটা তুলতে পারি না।’
‘কেন, ওতে কী হয়েছে?’
‘কাঁধে বাতের মতো হয়েছে।’
‘ফুলেছে?’
‘ফুলেছিল, কিন্তু এখন ফোলাটা গেছে।’
চোরটি ভদ্রলোকের দিকে রিভলবারটা ধরে দু-এক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। সে একবার ড্রেসিংটেবিলের ওপরে মালগুলোর দিকে চেয়ে দেখল, পরে একটু আধা অপ্রস্তুত হয়ে বিছানার ওপর ভদ্রলোকটার দিকে দেখল। পরে হঠাৎ একটা অদ্ভুত মুখোভঙ্গি করে হাসল।
ভদ্রলোক বিরক্ত হলেন। বললেন, ‘ও রকম করে আমার দিকে চেয়ে ঠাট্টা কোরো না। চুরি করতে এসেছ তো করো না। ওই তো কয়েকটা জিনিস পড়ে রয়েছে।’
চোরটি বলল, ‘আমাকে মাফ করবেন। আমারও একটু বাতের ব্যথা উঠল এখনই।’
ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, ‘কত দিন হলো তোমার বাত হয়েছে?’
‘চার বছর।’
ভদ্রলোক একটু কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কখনো ঝুমঝুমি সাপের তেল ব্যবহার করেছিলে?’
সিঁধেল চোরটি বলল, ‘পিপে পিপে ব্যবহার করেছি। আমি যত সাপের তেল ব্যবহার করেছি, সেগুলো যদি যোগ করা হয়, তাহলে এখান থেকে শনিগ্রহ যত দূর তার আট গুণ লম্বা হবে, আর ঝুমঝুমির শব্দ ইন্ডিয়ানার ভ্যালপ্যারিসো পর্যন্ত শোনা যাবে; আবার তার প্রতিধ্বনি ফিরে আসবে।’
ভদ্রলোক বললেন, ‘কেউ কেউ চিজেলামস পিল ব্যবহার করে।’
চোরটি বলল, ‘একেবারে বাজে, পাঁচ মাস আমি খেয়েছি, কিচ্ছু হয়নি। আমি এক বছর ফিঙ্কেলহ্যামস একস্ট্র্যাক্ট, বাম-অফ-জিলেড-পুলটিস আর পটস পেন-পালভারাইজার ব্যবহার করে একটু আরাম পেয়েছিলাম।’
ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, ‘ব্যথাটা তোমার রাতে বাড়ে, না সকালে?’
চোরটি বলল, ‘রাতে, আর ঠিক ওই সময়টাতেই আমার কাজের চাপ সবচেয়ে বেশি। আচ্ছা, এবার আপনার হাতটা নামিয়ে নিন। একটা কথা-আপনি কখনো ব্লিকারস্টাফর ব্লাড-বিল্ডার ব্যবহার করে দেখেছেন?’
‘না, আমি কখনো ব্যবহার করিনি। তোমার ব্যথাটা কি মাঝেমধ্যে হয়, না সব সময়ই লেগে আছে?’
চোরটি বিছানার পায়ের দিকে বসল, তার রিভলবারটা তার নিজের জোড়া হাঁটুর ওপর রাখল।
বলল, ‘এটা হঠাৎ হয়। যখন হওয়ার কোনো কথা নয়, তখনই হয়তো ব্যথাটা চাগিয়ে ওঠে। সে জন্য দোতলা বাড়িতে আমি চুরি করা ছেড়ে দিয়েছি। কারণ, কয়েকবার মাঝখানেই আটকে গিয়েছিলাম। তবে আপনাকে বলি-আসলে ডাক্তাররাও বলতে পারেন না কিসে এ রোগ সারে।’
‘ঠিক বলেছ, আমি প্রায় হাজার ডলার খরচ করেছি, কিন্তু কোনো উপকার পাইনি। তোমার ফোলে?’
‘হ্যাঁ, সকালবেলাটা, আর যখন বৃষ্টি হয়, সে যে কী কষ্ট!’
ভদ্রলোক বললেন, ‘আমারও। সামান্য এক ঝাপটা জোলো হাওয়াও কখন ফ্লোরিডা থেকে এখানে রওনা দিতে শুরু করল তা আমি এখান থেকেই বলে দিতে পারি। আর ম্যাটিনি-শোর দিনে থিয়েটারের পাশ দিয়ে যদি কখনো যাই তো ভেতরের এয়ারকন্ডিশনারে ঠান্ডা হাওয়া আমার হাতে এসে লাগলে এমন কনকনানি হয় যে আমি একেবারে দাঁতের ব্যথার মতন লাফিয়ে উঠি।’
সিঁধেল চোরটি বলল, ‘যাকে বলে একেবারে নরক-যন্ত্রণা।’
ভদ্রলোক বললেন, ‘তুমি ঠিক বলেছ।’
চোরটি এবার তার রিভলবার পকেটে পুরে একটু আরাম করে বসল।
বলল, ‘আচ্ছা, একটা কথা বলুন তো, কখনো অপোডেলডক ব্যবহার করেছেন?’
ভদ্রলোক রেগে গিয়ে বললেন, ‘বাজে, তার চেয়ে রেস্টুরেন্টের মাখন মাখা ভালো।’
চোর একমত হলো, বলল, ‘ঠিক বলেছেন, বাচ্চা ছেলেদের বেড়ালে আঁচড়ে দিলে সেখানে লাগালে কাজ হয়। ওসব জিনিসে আমাদের কাজ হবে না, এই আপনাকে বলে রাখছি। একটা জিনিসে শুধু এর আরাম হয়। বলব? ছোট্ট ওষুধ বটে কিন্তু সেটা বেশ আরামদায়ক। সেটা হলো মদ। আচ্ছা, আজকে নাহয় চুরি করাটা থাক, আপনার জামাকাপড়টা পরে নিন না, একসঙ্গে দুজনে বেরিয়ে একটু খাওয়া যাক, কিন্তু উঃ! ওই আবার ব্যথাটা চাগিয়েছে।’
ভদ্রলোক বললেন, ‘এক সপ্তাহ ধরে আমার কী হয়েছিল, কারোর সাহায্য ছাড়া আমি জামাকাপড় পর্যন্ত পরতে পারতাম না। আমার চাকর টমাস বোধ হয় এখন ঘুমুচ্ছে, আর-’
চোরটি বলল, ‘আপনি উঠুন, আমি আপনার জামা পরিয়ে দিচ্ছি।’
সংস্কারে যেন বাধতে লাগল ভদ্রলোকের। তিনি তাঁর কাঁচা-পাকা দাড়িতে হাত দিলেন।
বলতে গেলেন, ‘না না, এটা খারাপ দেখায়-’
সিঁধেল চোরটি বলল, ‘এই আপনার শার্ট নিন। উঠে পড়ুন। আমি একটা লোককে জানি, যিনি মাত্র দুহপ্তা অম্বেরিস অয়েন্টমেন্ট ব্যবহার করে এমন ভালো হয়ে গেলেন যে দুহাত দিয়ে তাঁর পোশাক পরতে পারতেন।’
ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথে ভদ্রলোক হঠাৎ পেছন ফিরলেন।
বললেন, ‘সঙ্গে টাকা নিতে ভুলে গেছি, ড্রেসিংটেবিলের ওপরে রেখে দিয়েছিলাম কাল রাতে।’
চোরটি তাঁর ডান হাতটা ধরে থামিয়ে দিল।
বলল, ‘আসুন আসুন, আমি আপনাকে আসতে বলেছি। টাকার কথা আপনাকে ভাবতে হবে না, আমার কাছে টাকা আছে। আচ্ছা, কখনো উইচ হ্যাজেল আর উইনটার-গ্রিনের তেল ব্যবহার করেছেন?’
অনুবাদঃ বিমল মিত্র
ও হেনরি, বিখ্যাত গল্পকার ও হেনরির আসল নাম উইলিয়াম সিডনি পোর্টার। জন্ম ১১ সেপ্টেম্বর ১৮৬২। মৃত্যু ৫ জুন ১৯১০।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ২২, ২০০৯
Leave a Reply