বুয়েটের মধুর কিছু স্মৃতি মনে উঁকি দিচ্ছে। বুয়েটের পোস্টারিং সংস্কৃতি কী অকৃত্রিম বিনোদনটাই না দিয়েছে আমাদের! বুয়েটে বেশ কিছু আন্দোলন আমরা পেয়েছিলাম। পেয়েছিলাম মানে করেছিলামও। যেমন ২০০৫-এ বন্যা আন্দোলন। অবশ্য এসব আন্দোলন একটা চূড়ান্ত দাবিতে গিয়েই ঠেকত। পরীক্ষা পেছানো। (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) বেশির ভাগ আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত হয়ে যেত পরীক্ষা পেছানো আন্দোলন। আর আন্দোলন মানেই আমাদের হলগুলোর ডাইনিংয়ের সামনে যে দীর্ঘ টেবিল, তা ভরে উঠত পোস্টারে পোস্টারে। প্রতিটি পোস্টারেই বিভিন্ন দাবিদাওয়া এবং সব পোস্টারের শেষেই প্রচারক হিসেবে লেখা থাকত ‘বুয়েটের সাধারণ ছাত্রছাত্রী’ কথাটা। ব্যাপারটা এমন, একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কোনো ছাত্রের মনে হলো, পিএল (পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার ছুটি) আরও চার সপ্তাহ বাড়ুক। তো, সে একটি পোস্টার লিখবে। পোস্টারের বক্তব্য হবে-এই সংকটময় মুহূর্তে কোনোভাবেই পরীক্ষা দেওয়া যায় না। অতএব পিএল আরও চার সপ্তাহ বাড়ানো হোক। পোস্টারের নিচে লিখে দেবেন ‘প্রচারে-বুয়েটের সাধারণ ছাত্রছাত্রী’!
২০০৬-এর ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে বুয়েটে দীর্ঘবিস্তৃত আন্দোলন হয়েছিল। বিশ্বকাপ ফুটবল দেখব, তাই পরীক্ষা দেব না-এটাই আন্দোলনের মূলমন্ত্র। পুলিশও হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি। আন্দোলনকারীদের ওপর কাঁদানে গ্যাস ছুড়েছে, ‘মৃদু’ লাঠিচার্জও করেছে। এ রকম হুল্লোড়ময় এক সন্ধ্যায় আমি শেরেবাংলা হলের দ্বিতীয় তলার টয়লেটের দিকে এগোচ্ছিলাম। শেরেবাংলা হলের এই ফ্লোর থেকে নিচের রাস্তা সরাসরি দেখা যায়। তো দেখি, সেই রাস্তা ধরে আমার প্রিয় বন্ধু আমিন হেঁটে আসছে। লম্বা, টিংটিঙে; একটু বাঁকাত্যাড়া হয়ে সে হাঁটে। নিচ থেকে আমাকে দেখেই হাঁক ছাড়ল। তার গলায় যথেষ্ট ঝাঁঝ, ‘···এর পুত, বুয়েটের সাধারণ ছাত্ররা পুলিশের লাঠির বাড়ি খাইতেছে, আর তুমি এইখানে খাড়ায় খাড়ায় তামশা দেখো!’ একটু ভড়কে গেলাম। নিজেকে কেমন অপরাধী অপরাধী লাগতে শুরু করল। বুয়েটের সাধারণ ছাত্ররা পুলিশের হাতে মার খাচ্ছে আর আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি? কিন্তু তখনো ঘটনার পরিহাসময় অংশটা জানতে পারিনি। সেটা জানতে পারলাম আন্দোলন ঠান্ডা হওয়ার পর। ব্যাপারটা হলো, সাধারণ ছাত্র বিষয়ে ডায়ালগ দেওয়ার কিছুক্ষণ আগে আমিন আসলে নিজেই পুলিশের লাঠির বাড়ি খেয়ে হলে ফিরছিল!
‘সাধারণ’ শব্দটা নিয়ে একটি যুগান্তকারী আইডিয়া বের করেছিল শেরেবাংলা হলের আমার আরেক বন্ধু রানা। সে একটি কোম্পানি খুলবে, যার নাম হবে ‘সাধারণ কেমিক্যাল কোম্পানি’। এই কোম্পানির আয়ের মূল উৎস হবে মামলার ক্ষতিপূরণের টাকা। কীভাবে? দাঁড়ান, খুলে বলি। ‘সাধারণ কেমিক্যাল কোম্পানি’ সাবান, শ্যাম্পু, পাউডার, ক্রিম সবই তৈরি করবে। সব পণ্যের নাম হবে ‘সাধারণ’। মানে ‘সাধারণ সাবান’, ‘সাধারণ শ্যাম্পু’, ‘সাধারণ টয়লেট ক্লিনার’-এ রকম আর কি। এতে ফায়দাটা কী? খেয়াল করে দেখবেন, টেলিভিশনে সাবান, শ্যাম্পু যারই বিজ্ঞাপন দেখানো হোক না কেন, সেখানে সাধারণ সাবান, সাধারণ শ্যাম্পুকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়। যেমন-‘আমাদের এই সাবান সাধারণ সাবানের চেয়ে দ্বিগুণ ময়লা সাফ করে’; কিংবা ‘সাধারণ টয়লেট ক্লিনার যেখানে ৭০ ভাগ জীবাণু সাফ করে, সেখানে আমাদের কোম্পানির টয়লেট ক্লিনার জীবাণু সাফ করে শতকরা ১০০ ভাগ’। রানার কোম্পানি বাজারে আসামাত্র অন্য সব কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করবে। কারণ, সবাই ‘সাধারণ সাবান’ কিংবা ‘সাধারণ টয়লেট ক্লিনার’-এর বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত! সেই মামলার ক্ষতিপূরণ বাবদ আয়টা কত হতে পারে, একবার ভেবে দেখুন।
আবার আমিনের ঘটনায় ফিরি। নিজেকে সাধারণ ভাবা কিন্তু বিশেষ একটি ব্যাপার। আমরা কেউই নিজেদের সাধারণের দলভুক্ত করতে চাই না। আপনি একজন ঘুষখোর সরকারি কর্মচারীর সামনে বলুন যে সরকারি কর্মচারীরা সাধারণত ঘুষ খান-ব্যাপারটাকে তিনি অপমান হিসেবে নেবেনই না। কারণ, সাধারণে যা করে তাতে তাঁর কী আসে-যায়? তিনি তো আর সাধারণ নন! আমরা যখন বলি, জনসাধারণ রাস্তা ময়লা করে, শব্দদূষণ করে, পরিবেশ দূষণ করে-তখন কিন্তু আমরা নিজেদের দিকে ফিরে তাকাই না। অথচ জনসাধারণকে গালি দেওয়া মানে তো নিজেকেও গালি দেওয়া। কবে যে আমরা নিজেদের ‘সাধারণ’ ভাবতে শিখব!
তানিম হুমায়ুন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ২২, ২০০৯
Leave a Reply