রহমান সাহেব পড়েছেন ভীষণ মুসিবতে। পুরান ঢাকা ছেড়ে মোহাম্মদপুরে বাড়ি বানালেও এখনো কোনো কিছুতে বি্নয় প্রকাশ করতে ‘আব্বে হালায় কয় কি!’ই তাঁর একমাত্র অবলম্বন।
কোনো ‘মুসিবতে’ পড়লে তিনি সাধারণত আমার কাছেই আসেন শলাপরামর্শ করতে। দেখলেই মুখ থেকে জর্দার ঘ্রাণ ছুটিয়ে বলে ওঠেন, ‘আরে ছাংঘাতিক (সাংঘাতিক নয়, সাংবাদিকের অপভ্রংশ) ছাহেব, আইছেন···কেমুন আছেন?’
সেদিন প্রায় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন আমার কাছে। মুখ থমথমে। ‘ছাংঘাতিক ছাহেব, হুনছেননি, ঘড়ির কাঁটা নাকি ছরকারে আগায় দিবার কইছে। আব্বে হালায় কয় কি! ঘড়ির কাঁটা পামু কই। আমার বাড়িতে কুনো ঘড়িতেই তো কাঁটা নাইক্কা। ছবগুলান ঘড়িই তো ডিজিটাল।’
ডিজিটাল ঘড়িতে কাঁটা এগিয়ে আনা মুশকিলই বটে। তার চেয়েও বড় মুশকিলে পড়েছে দেবা। দেবা হলো সেই প্রজাতির একজন, যারা জন্ম থেকেই ‘লেট লতিফ’। ভানু বাবুর ভাষায়, ‘সেই যে জন্মের সময় দুই ঘণ্টা ১০ মিনিট লেট, আজও কাভার করতে পারল না।’
শৈশবে খেলার মাঠে দেখেছি, সবাই হাজির। শুধু দেবার পদধূলি পড়ল ঠিক দেড় ঘণ্টা পরে! কয়েকবার ‘ডেটিং’য়ের টাইম ঠিক রাখতে না পারার দায়ে দেবা দেবদাস পর্যন্ত হয়েছে। সেই মুশকিল আসান হয়েছে চাকরিজীবনে! কোনো রকমে একটা সরকারি চাকরি বাগিয়ে নিয়েছে দেবা। সেখানেতো লেট লতিফদেরই জয়জয়কার।
আমরা পরিচিতরা অবশ্য ওর সময়ের সঙ্গে ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা নয়, দেড় ঘণ্টাই এগিয়ে রাখি। আর তাই ১০টায় কোথায় ওর সঙ্গে দেখা করার কথা থাকলে সাড়ে ১১টার আগে ওই এলাকাই মাড়াই না। এই নিয়মে দিব্যি চলছে। এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে এক ঘণ্টা এগিয়ে যাওয়া মানে তো দেবা পিছিয়ে পড়ল পুরো আড়াই ঘণ্টা!
এই নিয়ে দেবা নিজেও ইদানীং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তবে কদিন আগে রেডিওর একটা লাইভ ফোনইন অনুষ্ঠান শোনার পর মনে হলো, দেবা এতটা দুশ্চিন্তায় না ভুগলেই পারে। সেখানে এক বক্তার সাফ জবাব, আমরা জাতিগতভাবেই লেট-লতিফ। বাংলাদেশ এমন একটা দেশ যেখানে ‘বাঙালি-টাইম’ বলেই একটা অলিখিত নিয়ম চালু হয়ে গেছে। এখানে সবার ঘড়ির কাঁটা এমনিতেই কম-বেশি এগিয়ে রাখা আছে। নয়টার ট্রেন কয়টায় ছাড়ে- মোবাইল ফোনের ওই বিজ্ঞাপনের ভাষায় বলি-এ প্রশ্ন শুধু বাংলায় সম্ভব।
আরেক বক্তা ওই একই অনুষ্ঠানে দেখলাম (আসলে শুনলাম) বেশ ঝাঁজাল গলায় তাঁর মন্তব্য দিলেন, ‘‘ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে আনায় সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়বে এ দেশের নিপীড়িত, অভাবী জনতা, যারা দু বেলা অন্ন পায় না। দিনের সময় বেড়ে গেলে তাদের ক্ষুধা লাগবে বেশি বেশি। কে দেবে এই খাবার? এ জন্যই কবি বলে গেছেন, ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়···’।’’
শুধু শুধু বাঙালির ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে লাভ নেই। সময় নিয়ে কারচুপি সেই খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬ সাল থেকেই চলে আসছে! ওই সময় রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার চান্দ্রবর্ষের বদলে সৌরবর্ষ চালু করেন। আগের ভুলসর্বস্ব ক্যালেন্ডারের ঘাটতি পুষিয়ে নিতে নতুন ক্যালেন্ডারটির নভেম্বর-ডিসেম্বরের মাঝামাঝি দুটি অতিরিক্ত মাস যোগ করা হয়। ফেব্রুয়ারি-মার্চের মধ্যে যোগ করা হয় অতিরিক্ত তিনটি সপ্তাহ, যার ফলে বছরটি পৃথিবীর ইতিহাসের দীর্ঘতম বছরে পরিণত হয়। শেষ পর্যন্ত ৪৪৫ দিনে গড়ায়!
ওই সময় সিজারের বিরুদ্ধে সময় চুরির অভিযোগ পর্যন্ত আনা হয়েছিল। এ-ই হয়, যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর! তবে জুলিয়ান বর্ষপঞ্জিও কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমাধান দিতে পারেনি। পারেনি বলেই ১৫৮২ সালে চালু হয়েছিল গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। এখন যাঁরা, ‘আহা, খামোখাই এক ঘণ্টা বয়স বেড়ে গেল’ বলে আফসোস করছেন, জেনে খুশি হবেন, পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি আমলে এক-দুই ঘণ্টা নয়, এগিয়ে দেওয়া হয়েছিল পাক্কা ১০ দিন! তাই ১৫৮২ সালের ৫ থেকে ১৪ অক্টোবরের কোনো হদিস নেই ইতিহাসের পাতায়! ১৫৮২ সালের ৪ অক্টোবর মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমাতে গেল এবং পরদিন ঘুম থেকে উঠে অবাক বি্নয়ে আবিষ্কার করল, সে দিনের তারিখটা ৫ নয়, ১৫ অক্টোবর!
সে সময়ও কম হাঙ্গামা হয়নি। আয়ুষ্কালেরই ১০-১০টা দিন কেড়ে নেওয়ার পাঁয়তারা করছেন পোপ-এমন অভিযোগও তোলা হয়েছিল। ‘ফিরিয়ে দাও ১০ দিন’ ্লোগান প্রকম্পিত করেছিল ভ্যাটিকান সিটির সদর দরজা।
তাই এক ঘণ্টা এগিয়ে নেওয়ার সঙ্গে আমাদের মানিয়ে নেওয়াই ভালো। বিশেষ করে রেডিওর ওই বক্তা যখন দাবি করছেন, আমরা বাঙালি জাতিগতভাবে লেট-লতিফ!
রাজীব হাসান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ১৫, ২০০৯
Leave a Reply