বদনচন্দ্র চৌধুরী একজন নবাগত নারকী। যমরাজ নরক পরিদর্শনে বেরিয়েছেন। তাঁকে দেখে বদন হাতজোড় করে উবুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন।
যম বললেন, কী চাই তোমার?
-আজ্ঞে, দুই ঘণ্টার জন্য ছুটি।
-কবে এসেছ এখানে?
-আজ এক মাস হলো।
-এর মধ্যেই ছুটি কেন?
-আজ্ঞে, একবার মর্তলোকে যেতে চাই। আজ বিকেলে পাঁচটার সময় ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে আমার জন্য শোকসভা হবে, বড্ড ইচ্ছে করছে একবার দেখে আসি।
যমালয়ের নিবন্ধক অর্থাৎ রেজিস্ট্রার চিত্রগুপ্ত কাছেই ছিলেন। যম তাঁকে প্রশ্ন করলেন, এই প্রেতটার প্রাক্তন কর্ম কী?
চিত্রগুপ্ত বললেন, এর পূর্বনাম বদনচন্দ্র চৌধুরী, পেশা ছিল ওকালতি তেজারতি আর নানা রকম ব্যবসা। এক মাস হলো এখানে এসেছে, হরেক রকম বজ্জাতির জন্য হাজার বছর নরকবাসের দণ্ড পেয়েছে। বর্তমান আচরণ ভালোই। ঘণ্টা দুয়ের জন্য ছুটি মঞ্জুর করা যেতে পারে। শোকসভায় ওর বন্ধু আর স্তাবকেরা কে কী বলে তা শোনার জন্য আগ্রহ হওয়া ওর পক্ষে স্বাভাবিক।
-ও খবর পেল কী করে যে আজ শোকসভা হবে?
-খবরের অভাব কী ধর্মরাজ, রোজ কত লোক মরে সোজা নরকে চলে আসছে।
-বেশ, দুই ঘণ্টার জন্য ওকে ছেড়ে দাও, সঙ্গে একজন প্রহরী থাকে যেন।
চিত্রগুপ্ত হাঁক দিয়ে বললেন, ওহে কাকজঙ্ঘ, তুমি এই পাপীর সঙ্গে মর্তলোকে যাও। ঠিক দুই ঘণ্টা পরই ফেরত আনবে।
‘যে আজ্ঞে’ বলে যমদূত কাকজঙ্ঘ বদন চৌধুরীকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
অনন্তর যমরাজ অন্য এক মহলে এলেন। তাঁকে দেখে ঘনশ্যাম ঘোষাল কৃতাঞ্জলিপুটে দণ্ডবৎ হলেন।
যম বললেন, তোমার আবার কী চাই?
-আজ্ঞে, দুই ঘণ্টার জন্য ছুটি। একবার মর্তলোকে যেতে চাচ্ছি।
-তোমারও শোকসভা হবে নাকি? এখানে এসেছ কবে?
-দুই বছর হলো এখানে এসেছি। আমার জন্য কেউ শোকসভা করেনি প্রভু। বন্ধুরা বড়ই নিমকহারাম, আমার মৃত্যুর পর আমারই ‘কালকেতু’ কাগজে মোটে আধ-কলম ছেপেছিল, একটা ভালো ছবি পর্যন্ত দেয়নি। বদন চৌধুরী বন্ধু ছিলেন, তাঁর শোকসভায় যাওয়ার জন্য ছুটি চাচ্ছি।
চিত্রগুপ্ত তাঁর খাতা দেখে বললেন, তুমি অতি পাঁজি প্রেত, যমালয়ে এসেও মিছে কথা বলছ। তোমার কাগজে তো চিরকাল বদন চৌধুরীকে গালাগালি দিয়েছ।
-মরণের পর শত্রুতার অবসান হয়েছে, আমরা আবার বন্ধু হয়ে গেছি।
যম চিত্রগুপ্তকে বললেন, যাকগে, দুই ঘণ্টার জন্য একেও ছেড়ে দিতে পারো। সঙ্গে যেন একটা প্রহরী থাকে।
চিত্রগুপ্তের আদেশে যমদূত ভৃঙ্গরোল ঘনশ্যামের সঙ্গে গেল।
পরলোকগত বদন চৌধুরীর শোকসভায় খুব লোকসমাগম হয়েছে। বেদির ওপর আছেন সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ রায়বাহাদুর গোবর্ধন মিত্র, তাঁর ডান পাশে প্রধান বক্তা অধ্যাপক আঙ্গিরস গাঙ্গুলী, বাঁ পাশে বদনের বন্ধু ও সভার আয়োজক ব্যারিস্টার কোকিল সেন। বক্তাদের জন্য দুটো মাইক্রোফোন খাড়া হয়ে আছে এবং সভার বিভিন্ন স্থানে কতক লাউডস্পিকার বসানো হয়েছে।
বদন চৌধুরী তাঁর রক্ষী যমদূতের সঙ্গে বেদির ওপরই দাঁড়িয়েছিলেন।
ঘনশ্যাম ঘোষালকে দেখে বললেন, তুমি কী মতলবে এখানে এসেছ? সভা পণ্ড করতে চাও নাকি?
ঘনশ্যাম বললেন, আরে না না, পণ্ড করব কেন, তুমি হলে আমার পুরোনো বন্ধু। তোমার গুণকীর্তন শুনে প্রাণটা ঠান্ডা করতে এসেছি। দুই যমদূত নিজের নিজের বন্দীর কাঁধে হাত দিয়ে রইল। সভার কোনো লোক এই চারজনের অস্তিত্ব টের পেলেন না।
প্রথমে শ্রীযুক্তা ভূপালী বসুর পরিচালনায় সংগীত হলো। -আজি ্নরণ করি পুণ্য চরিত বদনচন্দ্র চৌধুরীর, সেই স্বর্গগত রাজর্ষির; লোকমান্য অগ্রগণ্য কর্মযোগী ধর্মবীর। ···ইত্যাদি। তারপর অধ্যাপক আঙ্গিরস গাঙ্গুলী মৃত মহাত্মার কীর্তিকথা সবিস্তারে বলতে লাগলেন।
আরও কয়েকজন বক্তৃতা দেওয়ার পর ব্যারিস্টার কোকিল সেন দাঁড়ালেন। আগের বক্তারা যেটুকু বাকি রেখেছিলেন তা নিঃশেষে বিবৃত করে ইনি বললেন, আমি প্রস্তাব করছি, সেই স্বর্গগত মহাপুরুষের একটি মর্মরমূর্তি দেশবন্ধু বা দেশপ্রিয় পার্কে স্থাপন করা হোক এবং তদুদ্দেশে চাঁদা তোলা আর অন্যান্য ব্যবস্থার জন্য অমুক অমুককে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হোক।
পেছন বেঞ্চ থেকে একজন শ্রোতা বললেন, বদন চৌধুরীকে আমরা বিলক্ষণ জানতুম। মরা মানুষের নিন্দে করতে চাই না, কিন্তু তার মূর্তির জন্য আমরা কেউ একপয়সা চাঁদা দেব না।
সভায় হাততালি হলো, প্রথমে অল্প, যেন ভয়ে ভয়ে, তারপর খুব জোরে। গোলমাল থামলে সভাপতি গোবর্ধন মিত্র উঠে তাঁর ভাষণটি পড়ার উপক্রম করছেন, এমন সময় হঠাৎ ঘনশ্যাম তড়াক করে লাফিয়ে তাঁর কাঁধে চড়লেন। যমদূত ভৃঙ্গরোল আটকাতে গেল, কিন্তু ঘনশ্যাম নিমিষের মধ্যে গোবর্ধনবাবুর কানের ভেতর দিয়ে তাঁর মরমে প্রবেশ করলেন।
তারপর ঘনশ্যামের প্রেতাত্মা তারস্বরে বক্তৃতা শুরু করল।-
ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, আমার বেশি কিছু বলার নেই। শেষের বেঞ্চের ওই ভদ্রলোকটি যা বলেছেন তা খুব খাঁটি কথা। তার খোশামুদে আত্মীয়স্বজন তাঁকে দেবতা বানানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। কিন্তু এখন আর ধাপ্পাবাজি চলবে না। বদন স্বর্গে যায়নি, নরকেই গেছে। অমন জোচ্চোর ছ্যাঁচড় হারামজাদা লোক আর হবে না মশাই, কত মক্কেলের সর্বনাশ করেছে, করপোরেশনে আর অ্যাসেমব্লিতে থাকতে হাজার হাজার টাকা ঘুষ খেয়েছে, পারমিটে আর কালোবাজারে লাখ লাখ টাকা-
বদন চৌধুরী চুপ করে থাকতে পারলেন না। যমদূত কাকজঙ্ঘকে একধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে তিনি অধ্যাপক আঙ্গিরস গাঙ্গুলীর শরীরে ভর করলেন। দ্বিতীয় মাইকটা টেনে নিয়ে চিৎকার করে বললেন, আপনারা বুঝতেই পারছেন যে আমাদের সভাপতি মশাই প্রকৃতিস্থ নেই। যে লোকটা পুণ্যশ্লোক রাজর্ষি বদনচন্দ্রের ঘোর শত্রু ছিল, সেই নটোরিয়াস কাগজি গুণ্ডা কালকেতুর সম্পাদক ঘনা ঘোষালের প্রেতই সভাপতির ঘাড়ে চেপেছে এবং এই অসহায় গোবেচারা ভদ্রলোকের মুখ দিয়ে অশ্রাব্য কথা বলছে-
সভাপতির জবানিতে ঘনশ্যাম বললেন, একেবারে ডাহা মিথ্যে কথা। সেই বজ্জাত বদনার ভূতই অধ্যাপক আঙ্গিরস গাঙ্গুলী মশাইকে কাবু করে যা-তা বলছে-
আঙ্গিরস গাঙ্গুলীর মারফত বদন চৌধুরী বললেন, আপনারা কি সেই ব্লাকমেইলার শয়তান ঘনা ঘোষালকে ভুলে গেছেন? ব্যাটা টাকা খেয়ে তার কাগজে কালোবাজারি চোরদের প্রশংসা ছাপত, টাকা না পেলে গাল দিত। মন্ত্রীদের ভয় দেখিয়ে সে নিজের ওয়ার্থলেস ছেলেমেয়ে শালাশালীদের জন্য ভালো ভালো চাকরি জোগাড় করেছিল।
সভায় তুমুল কোলাহল উঠল। এই সময়ে দুই যমদূত গোবর্ধন মিত্র আর আঙ্গিরস গাঙ্গুলীর কানে কানে বলল, বেরিয়ে এসো শিগগির, দুই ঘণ্টা কাবার হয়েছে। দুই প্রেতাত্মা সুড়ুৎ করে বেরিয়ে এল, যমদূতেরা তখনই তাদের নিয়ে উধাও হলো। (সংক্ষেপিত)
পরশুরামঃ কথাসাহিত্যিক। জন্ম-১৮৮০, মৃত্যু-১৯৬০।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০৮, ২০০৯
Leave a Reply