দুলাল ও মতিন বিজ্ঞানের ছাত্র। কলেজে তাদের প্রিয় স্যার জিল্লু স্যার। তিনি পদার্থবিজ্ঞান পড়ান। জিল্লু স্যার বিজ্ঞানী মানুষ। সারা দিন গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কলেজেও তেমন একটা যান না। জিল্লু স্যার এখন নতুন একটা প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত। তিনি টাইম মেশিন তৈরি করছেন। তাঁর দুই অ্যাসিস্ট্যান্ট দুলাল আর মতিন। তারা দিন-রাত খেটে দীর্ঘ ছয় মাস পরিশ্রমের ফলে যেটা তৈরি করল, সেটা দেখে নিন্দুকেরা বলল, ভটভটিও নাকি দেখতে এর চেয়ে ভালো। তবু টাইম মেশিন বলে কথা। কয়েক দিনের মধ্যেই লোকজনের ঢল নামল দেখতে।
দুলাল একদিন জিল্লু স্যারকে বলল, ‘স্যার, আমরা যদি টাইম মেশিন দেখতে টিকিটের ব্যবস্থা করতাম, তাইলে ভালোই ইনকাম হইত। ওই টাকায় একটা মোটরসাইকেল কিনলে, আমি স্যার আপনাকে নিয়ে কলেজে আসতাম।’
এটা ডাহা মিথ্যা কথা। আসল ঘটনা হচ্ছে মিলি। তাদের কলেজে পড়ে। পরির মতো দেখতে। মিলির এক কথা, একমাত্র মোটরসাইকেলের মালিক হলেই তার ভালোবাসা পাওয়া যাবে। দুলালের এখন একটা মোটরসাইকেলের খুব প্রয়োজন। কেউ যদি টাইম মেশিন নিয়ে তাকে একটা মোটরসাইকেল দেয়, তাহলে দুলাল টাইম মেশিনটা চুরির ব্যবস্থা করবে।
মতিন বলল, ‘স্যার, আমি যদি এই টাইম মেশিনে চড়ে অতীতে, ধরেন ১০ বছর পেছনে ফিরে যাই, তখন কি মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসটা দেখতে পারব?’
‘সেটা সম্ভব না। টাইম মেশিনে চড়ে আমরা শুধু ভবিষ্যতে যেতে পারব। অতীতে নয়।’
‘তাইলে চলেন স্যার আমরা ভবিষ্যৎ থেকে ঘুরে আসি।’
কিন্তু সমস্যা জটিল। জিল্লু স্যারের টাইম মেশিন পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। এটা ভবিষ্যতে যেতে পারবে। ফিরতে পারবে না বর্তমানে। কেউ টাইম মেশিনে চড়তে রাজি হচ্ছে না। দুনিয়ার মায়া বড় মায়া, ঘর-সংসার বউ-বাচ্চা ছেড়ে কেউ ভবিষ্যতে যেতে রাজি হচ্ছে না। জিল্লু স্যার পড়লেন মহা টেনশনে। এসব মায়ার জন্যই এ জাতির কপালে কিছু নেই।
দুলাল ভাবল, আর সময় নষ্ট করে কোনো লাভ নেই। অনেক দিন মিলির সঙ্গে দেখা হচ্ছে না। এবার নিশ্চয়ই টাইম মেশিনের খবরে সে খুশি হবে।
তাকে দেখে মিলি ফিক করে হেসে উঠল। কিসের হাসি ঠিক বোঝা গেল না। ‘দুলাল ভাই, আপনারা নাকি কী মেশিন বানাইছেন?’
‘হুম। এই একটা টাইম মেশিন।’
‘এখন কি এই মেশিন দিয়া আখের শরবত বানাইয়া বাজারে বেইচ্চা মোটরসাইকেল কিনবেন?’
দুলাল রাগে কষ্টে অভিমানে আর দাঁড়াল না। এক দৌড়ে জিল্লু স্যারের বাড়িতে। স্যার টাইম মেশিনের সামনে চেয়ার পেতে বসে আছেন। তাঁর হাতে ইংরেজি স্পোকেন বই। ইংরেজিতে কথা বলার প্রাকটিস করছেন- যদি টিভিতে সাক্ষাৎকার দিতে হয়, তারই প্রস্তুতি! দুলাল বলল, ‘স্যার, আমি আর এই সময়ে থাকতে চাই না। আমারে ভবিষ্যতে পাঠায়ে দেন।’
দুলালের কথা শুনে জিল্লু স্যার গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। এমন সুযোগ তিনি হাতছাড়া করতে রাজি নন। তিনি প্রায় ঠেলে দুলালকে টাইম মেশিনের মধ্যে বসিয়ে দিলেন। তারপর জানালা দিয়ে বললেন, ‘আমারও এই মানবসমাজে থাকতে ইচ্ছা করে না। আমিও তোমার সঙ্গে চলে যেতাম। কিন্তু আমি চলে গেলে টিভিতে সাক্ষাৎকার দেবে কে।’
সত্যি কথা বলতে কি, তিনি কষ্ট করে ইংরেজিতে সাক্ষাৎকার মুখস্থ করেছেন। টাইম মেশিন তৈরি করার চেয়ে ইংরেজি শেখা বেশি কঠিন। তিনি দুলালের পাশে তাঁর পোষা কুকুরটাকে বসিয়ে দিলেন। দুলালকে সাহস দিয়ে বললেন, ‘ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে তুমি চাইলে ১০০ বছর আগের কুকুর বলে এটাকে বেশি দামে বেচে একটা মোটরসাইকেল কিনতে পারবে।’
স্যার টাইম মেশিনের গায়ের কি-বোর্ডে একের পর এক বোতাম চেপে যাচ্ছেন। হঠাৎ যন্ত্রটা নড়ে উঠল। চুলায় ভাত ফোটার মতো একটা শব্দ শুরু হলো। শব্দের তীব্রতা বাড়ছে। দুলালের ইচ্ছে করছে মিলিকে দেখতে। একবার যদি মিলিকে দেখতে পেত! এর মধ্যে কুকুরটা কিঁউ করে কেঁদে উঠল। ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এল।
সাদা একটা ঘর। চারদিকে সাদা। হঠাৎ ফিসফিস শব্দ। অর্থহীন কথাবার্তা। এরপর দীর্ঘ নীরবতা। একটি নারীকণ্ঠ বলল, ‘পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে।’
দুলাল হাসপাতালে। মতিন তার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘দোস্ত, তোর হায়াত আছে। টাইম মেশিন বার্স্ট হয়েছিল। স্যারের কুকুরটা মরে গেছে। তুই বাঁইচা গেছিস।’
মিলিও এসেছে। সে দুলালের পাশে বসল। সে কাঁদছে, ‘আমার হাত ধরে শপথ করো। আমাকে ছেড়ে আর ভবিষ্যতে যাবে না।’
দুলালের মনে অনেক কথা, কিন্তু বলতে পারে না। শুধু ভাবে, মিলিকে ছেড়ে আপাতত সে আর কোথাও যাবে না।
— আহমেদ মামুন
প্রিয়াংকা হাউজিং, মিরপুর-১, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০১, ২০০৯
Leave a Reply