সুন্দর বাতাস বইছে, সেই বাতাসে অপুর ঘুড়ি সাঁই সাঁই করে ওপরে উঠছে। আজ সে তার ঘুড়িকে ওপরে নিয়ে যাবে। সুতা কিনে এনেছে দুই বান্ডিল। ঘুড়িটা এত ওপরে উঠেছে যে সেটাকে একটা গোল বিন্দুর মতো দেখাচ্ছে। হঠাৎ একটা আশ্চর্য জিনিস দেখল অপু, কালো রঙের গোল একটা চাকতির মতো প্লেন তার ঘুড়ির অল্প দূরে স্থির হয়ে আছে। নড়াচড়া করছে না। সেটা থেকে কেমন যেন লাল আলো বের হচ্ছে।
স্পেসশিপ ম্যাগপাই পৃথিবীর ওজোনস্তরে ঢুকে পড়েছে। পৃথিবী ধ্বংস মিশনের প্রথম দল এটি। কিছুদিন আগে তারা পৃথিবী নামক একটা গ্রহের সন্ধান পেয়েছে, যেখানে নিচু স্তরের বুদ্ধিমান প্রাণী বসবাস করে। এই সৌরজগতে অন্য কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী থাকুক তারা সেটা চায় না। তাই পৃথিবীকে ধ্বংস করার জন্য প্রায় ২২০ কোটি আলোকবর্ষ দূরের কিউবি গ্রহ থেকে তারা এসেছে।
স্পেসশিপে এখন চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। উত্তেজনার কারণ, স্পেসশিপের ৪০ গজ দূরে একটা বর্গাকৃতির বস্তু দেখা যাচ্ছে এবং সেটা নড়ছে। এই অভিযানের প্রধান ক্যাপ্টেন পালবা সুপার প্রোগ্রাম কিউ৩৬ ওপেন করলেন।
-স্বাগতম ক্যাপ্টেন পালবা।
-ভণিতা না করে ওই বর্গাকৃতির বস্তুটা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য দাও। বিরক্তভরা কণ্ঠে বললেন ক্যাপ্টেন পালবা। যেকোনো বিষয়ের ওপর তথ্য দিতে কিউ৩৬ খুব কম সময় নেয়। কিন্তু দুই মিনিট পর কিউ৩৬ জানাল, দুঃখিত, কোনো প্রকার তথ্য দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
-কেন?
-কারণ বস্তুটা সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু পদার্থ দ্বারা তৈরি এবং এর নির্মাণশৈলী জটিল ও কঠিন।
ক্যাপ্টেন পালবার চোয়াল ঝুলে পড়েছে। তিনি কৌতূহলী হয়ে বললেন, এ··· এ··· এটা কে পরিচালনা করছে।
-এই বর্গাকৃতির বস্তুটি একটা বালক পরিচালনা করছে। মনিটরে একটা দৃশ্য ভেসে উঠল। স্পেসশিপ ম্যাগপাইয়ের অর্ধশত বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী চরম বি্নয় নিয়ে দেখল একটা বালক। সবুজ মাঠের মধ্যে সে একা। তার হাতে চোঙাকৃতির বস্তু, যা দেখতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের মতো। সেটা সে দুই হাত দিয়ে ঘোরাচ্ছে। মাঝেমধ্যে তার পকেট থেকে কিছু একটা বের করে মুখের মধ্যে দিচ্ছে।
২·
অপু অবাক হয়ে প্লেনটা দেখছে। প্রায় প্রতিদিনই সে প্লেন দেখে। বড় বাজপাখির মতো একটা জাহাজ দুই ডানায় ভর করে প্রচণ্ড শব্দ করে উড়ে চলে যায়। কিন্তু এটা কেমন প্লেন, কালো, আবার গোল, এ রকম প্লেন সে জীবনেও দেখেনি। সবচেয়ে বড় কথা, প্লেনটা স্থির হয়ে আছে। অপুর মাথায় হঠাৎ একটা দুষ্টুবুদ্ধি ভর করল। সে পকেট থেকে একমুঠো চানাচুর গালে দিয়ে জামায় হাতটা মুছে নাটাইটা ডান দিকে কাত করে ঘোরাতে লাগল। ফলে ঘুড়িটা গোত্তা খেয়ে প্লেনটার দিকে ছুটল।
কিউ৩৬ বিপৎসংকেত দিতে শুরু করল। ‘বর্গাকৃতির বস্তুটি স্পেসশিপের শক্তিবলয় অতিক্রম করে এগোচ্ছে···।’
ক্যাপ্টেন পালবা হতভম্ব হয়ে গেলেন। তিনি কিউ৩৬ কে বললেন, ‘কী ব্যাপার, বস্তুটা আমাদের শক্তিবলয় ভেদ করল কীভাবে?’
-আমি আগেই বলেছি, এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন পদার্থ দিয়ে তৈরি, আর এ কারণে শক্তিবলয় চিহ্নিত করতে পারছে না। ফলে বল প্রয়োগও করতে পারছে না।
-এ··· এটা তো আমাদের দিকেই আসছে।
-জি।
-এখন কী করব?
-আমাদের ফিরে যাওয়াই উচিত। এ বস্তুটির অকল্পনীয় পারমাণবিক শক্তি থাকার সম্ভাবনা শতকরা ৮৩ দশমিক ০২ ভাগ।
ক্যাপ্টেন পালবা দ্রুত চিন্তা করতে লাগলেন কী করা যায়। রাগে-দুঃখে তার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করছে। এত বড় অভিযান ভণ্ডুল হয়ে গেল। আজ এই প্রথম তিনি কোনো মিশনে বিফল হলেন। জিম কাল্টনকে (ম্যাগপাইয়ের চালক) তিনি কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বললেন, ‘ফিরে চলো।’
স্পেসশিপ ম্যাগপাই পৃথিবী ছেড়ে প্রচণ্ড গতিতে কিউবির দিকে ছুটে চলেছে। ক্যাপ্টেন পালবার চোয়াল ঝুলে পড়েছে।
৩·
অপু হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। জীবনে এত অবাক সে কখনো হয়নি। ঘুড়িটা প্লেনের দিকে যাচ্ছে, এমন সময় প্লেনটা উধাও। ওপরে, না নিচে গেল, নাকি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল? অপু যখন আর একমুঠো চানাচুর মুখে পুরবে তখন বাঁ কানে সূক্ষ্ম একটা ব্যথা অনুভব করল। তারপর বাঁ দিকে ফিরে দেখে তার বাবা।
‘হারামজাদা ইস্কুল ফালাইয়া ঘুড়ি উড়াও! তোরে অইজ খাইয়াই ফালামু···বাড়ি চল···।’
বাবা অপুর কান ধরে টানতে টানতে বাড়ির দিকে গেলেন।
কিউবি গ্রহের বিজ্ঞান একাডেমি পৃথিবী ধ্বংসের সব পরিকল্পনা বাতিল করেছে। সে গ্রহের একটা বালক যদি তাদের এভাবে ঘোল খাওয়ায়, তবে বয়স্করা কী করবে তা ভেবেই তারা শিউরে ওঠে। তবে তারা পৃথিবীর মানুষের বন্ধু হতে চায়। শিগগিরই তারা মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
অপুকে সেদিন তার বাবা খুব ধোলাই দিয়েছিলেন। সে বাবাকে বলেছে, জীবনে আর কোনো দিন ঘুড়ি ওড়াবে না।
— মেহেদী হাসান
নবম শ্রেণী, মডেল একাডেমি, মিরপুর-১, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০১, ২০০৯
Leave a Reply