ঘুম থেকে উঠেই আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। আমি কোথায়? কাল রাতে সেগুন কাঠের বক্স খাটে আকাশি রঙের বিছানার চাদরের ওপর ঘুম দিয়েছিলাম। দেয়ালের রংও ছিল আকাশি। পাশে আমার মফিজ টেডি বিয়ারটিকে নিয়ে ঘুমিয়েছিলাম। আজ ঘুম ভাঙতেই এসব আজব জিনিস কী দেখছি!
খাটটি পারদ রঙের। দেয়ালের, বিছানার চাদরের এবং পর্দার রং গাঢ় নীল। খাটটি মনে হয় দুলিয়ে দুলিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছিল। আমি ঘুমের মধ্যে অনুভব করেছি, পাশে মফিজ নেই। মাথার ওপর যে ফ্যানটি ঘুরছে সেটাকে অনেকটা বিকলাঙ্গের মতো লাগছে। অর্থাৎ রোবটিক লাগছে। মনে হচ্ছে কেউ একে নিয়ন্ত্রণ করছে। লক্ষ করলাম, ফ্যানেরও লাল রঙের দুটি চোখ রয়েছে এবং কিছুক্ষণ পর হঠাৎ ফ্যানটি বলে উঠল, ‘এত জোরে বাতাস দিচ্ছি, তবুও আপনি ঘামছেন? আচ্ছা, আমি আমার আরও ছয়টি পাখা বের করছি।’ ফ্যানটি আস্তে আস্তে আরও ছয়টি পাখা বের করে সজোরে ঘুরতে শুরু করেছে। আমার রুমের সব জানালা আপনাআপনি খুলে যেতে লাগল এবং সঙ্গে এক সুরেলা কণ্ঠ ভেসে উঠল, ‘শুভ সকাল।’
আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি হাঁ হয়ে রইলাম। আকাশ মুহূর্তে তার রং বদলাচ্ছে। একবার আকাশি, একবার গোলাপি, একবার কমলা, একবার বাদামি প্রভৃতি বর্ণ সৃষ্টি করছে দেখে আমার অস্বস্তি লাগছে। তখন হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘মিস-সি১৬০৯০২২ উঠে পড়ুন, আপনার ব্রেকফাস্ট রেডি। তাড়াতাড়ি শাওয়ার করে খেতে বসুন।’ কণ্ঠটা শুনে আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। আজব কণ্ঠ, সম্পূর্ণ রোবটিক। পেছনে ফিরে আমি হতভম্বের মতো বলে উঠলাম, ‘আরে, এটা তো মফিজ!’ তখন মফিজ আকৃতির টেডি বিয়ারটি বলল, ‘সরি, আপনি ভুল করছেন, আমার নাম মফিজ নয়, আমার নাম টিবি১৩০৪৯৬।’ ‘কিন্তু তোমার নাম তো মফিজ!’ আমি প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে বললাম। মফিজ রোবটটি ধমকের সুরে বলল, ‘আপনি এর পর থেকে এসব আজেবাজে নামে আমাকে ডাকবেন না। আপনার এসব নাম শুনলে আমার বমি আসে; যদিও আমি বমি করতে পারি না, কিছু খেতে পারি না। আমার মনে আছে আপনি আপনার বান্ধবীদের সঙ্গে খেলার ছলে অনেক খাবারদাবার আমার মুখে ঠেসে দিয়েছিলেন। আবার না খাওয়ার ফলে আমাকে অনেক লাথি-ঘুষিও সহ্য করতে হয়েছে। আবার আপনার বান্ধবীরা আমাকে দিয়ে পুতুল বিয়েও খেলেছেন, মিস-সি১৬০৯০২২, আপনি আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছেন।’ এবার আমি খেপে বললাম, ‘এই মফিজ খবরদার, আমাকে এই সি১৬০··· যাই হোক ওই নামে ডাকবি না।’ সেও বলল, ‘আপনিও আমাকে মফিজ বলে ডাকবেন না, আমার নাম টিবি১৩০৪৯৬ এবং আপনার নাম সি১৬০৯০২২। আর এখন থেকে আপনাকে আমার ইচ্ছায় চলতে হবে এবং আমিই আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করব। এটা ওই যুগ না, আপনি এখন অন্য মাত্রার যুগে।’ আমি হাঁ হয়ে রইলাম। আমি অন্য যুগে, আবার আমাকে নিয়ন্ত্রণ করবে মফিজ! তখনই একটি যন্ত্রের মাধ্যমে আমাকে বাথরুমে নেওয়া হলো। বাথরুমে দাঁত মাজা থেকে শুরু করে চুলে শ্যাম্পু লাগিয়ে সাবান মেখে গোসল করানো সব যন্ত্রের কাজ। আমি শুধু পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। সবকিছু এখন কেন যেন স্বাভাবিক লাগছে। গোসল শেষে একটি চেয়ারের মতো যন্ত্র আমাকে ডাইনিং রুমে নিয়ে গেল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ডাইনিং টেবিলে তিনজন রোবট মানব বসে আছে। একজন বলে উঠল, ‘শুভ সকাল, মামণি।’ আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, উনি আমার বাবা! সঙ্গে সঙ্গে আমার মায়ের কণ্ঠের মতো একজন রোবট মানবী বলে উঠল, ‘তোমার আহ্লাদেই মেয়েটি এত অলস হয়েছে। দেখছ না, কী দেরিতে ঘুম থেকে উঠল।’ তার মেটালিক বর্ণের চুলগুলো ঝিলিক মারছে।
তাহলে আমার পাশে যে বসা সে আমার বড় ভাই! আমার বড় ভাই সব সময়ের মতো তামাশা করে বলতে লাগল, ‘আমরা ডিজিটাল যুগে আসার পর সবকিছু বদলালেও আমার বোনের আলসেমি বদলাবে না।’ ‘কী ডিজিটাল যুগ!’ তাহলে আমিও কি ডিজিটাল মানব!!!
— ফাইরুজ আয়ূব
তালতলা, টাঙ্গাইল।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০১, ২০০৯
Leave a Reply