পদার্থবিজ্ঞান ক্লাস। বিজ্ঞানের স্যার সাধারণত গম্ভীর হয়ে থাকেন। কিন্তু আবদুল মজিদ স্যার ব্যতিক্রম। তিনি সুযোগ পেলেই পদার্থবিজ্ঞানের বাইরে চলে যান। তিনি কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন, ‘বাবা, আজ আমি তোমাদের মৌলিক বল পড়াব। মৌলিক বল চার প্রকার। বুঝলা, পদার্থবিজ্ঞান কবিতা নয়। কঠিন জিনিস। কবিতা হইল প্রেমকাহিনী। কবিতা পইড়া এই জগতে কোনো উন্নয়ন হইব না। একটা কবিতা লিখলে মানবজাতির সামান্যতম কল্যাণ হয় না। আবার না লিখলেও কারও কোনো ক্ষতি হয় না। বলো হয়?’
‘না, স্যার, হয় না।’ আমরা চিৎকার করে জবাব দিই।
এক কবি লিখছেন-
‘যদি আমায় মনে পড়ে
মেঘের ডানায় চড়ে
ভাসব উড়ে ু’
এটা ডাহা মিথ্যা কথা। মেঘ হইল কুয়াশার মতো। মেঘে চইড়া মানুষ উড়তে পারলে আর বিজ্ঞানীদের প্লেন বানানোর প্রয়োজন পড়ত না। আর ডানা এল কীভাবে?
‘আফসোস, তোমরা গাঁটের পয়সা খরচ করে এই ডাহা মিথ্যা কথা ক্রয় করো। এসব অর্থহীন কথাবার্তা পড়ো। সময় নষ্ট করো। সত্য আছে বিজ্ঞানের মধ্যে। সত্য জানতে হলে বিজ্ঞান পড়বা। বাবারা, আমি কি জানি বলছিলাম। ও মনে পড়েছে, মৌলিক বল। মহাবিশ্বে চার প্রকার মৌলিক বল বিদ্যমান। প্রথম শ্রেণীর হলো মহাকর্ষীয় বল। এই মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু একে অপরকে আকর্ষণ করে। এই আকর্ষণ বলকে মহাকর্ষীয় বল বলে। এই যে চাঁদ দেখছ, পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। এর কারণ মহাকর্ষীয় বল।’
দুই·
পরের দিন স্যার ক্লাসে বললেন, ‘আজ তোমাদের পড়াব দুর্বল বল ও নিউক্লীয় বল। এটাই হইল··· বাবারা, চতুর্থ প্রকার বল হলো তড়িৎ চৌম্বক বল। দুটি বিপরীত ধর্মের বস্তুর মধ্যে এই বল কাজ করে।’
এরপর স্যার মৌলিক বল সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিলেন। আমার একটা প্রশ্ন ছিল। কিন্তু ক্লাসে এ ধরনের প্রশ্ন করা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছি না। থাক, ক্লাস শেষ হোক। স্যারের রুমে গিয়ে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করব। ক্লাস শেষে স্যার বললেন, ‘বাবা, তোমরা মৌলিক বল নিশ্চয়ই বুঝেছ। এই চার প্রকার বল মহাবিশ্বকে শাসন করে।’
তিন·
একদিন আমার বন্ধু মোতালেবকে দেখি কলেজের করিডরে দাঁড়িয়ে থাকা বিলকিসের দিকে তাকিয়ে আছে। বিলকিসও আড় চোখে মোতালেবকে দেখে। দুজনের চোখাচোখি হয়। মোতালেব এগিয়ে যায়। অজানা এক আকর্ষণ তাকে টেনে নিয়ে যায়। ক্লাসের ঘণ্টা পড়ে। বিলসিক ক্লাসে চলে যায়। মোতালেবও পেছনে পেছনে যায়। সে বিলকিসের কাছাকাছি একটি বেঞ্চিতে বসে।
এ ঘটনার পর থেকে বিলকিস-মোতালেব একসঙ্গে ক্লাসে আসে। একসঙ্গে বাড়ি ফেরে। দুজন পাশাপাশি হাঁটে। নদীর পাড়ে যায়। ছুটির দিন তারা বেড়াতে যায় দূরে কোথাও। বিলকিস কলেজে না এলে মোতালেব কলেজে থাকে না। সে বিলকিসের বাড়ির আশপাশে ঘোরে। বিলকিস হাসলে মোতালেব হাসে। বিলকিস কাঁদলে মোতালেব কাঁদে।
চার·
স্যার তাঁর রুমে বসে আছেন। একা। এখনই সুযোগ আমার নিজের গবেষণার বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার।
আমি বললাম, ‘স্যার, আপনি বলেছিলেন এই মহাবিশ্বে চার প্রকার মৌলিক বল আছে।’
‘জি।’
‘এই চার প্রকার বলের বাইরে কি কোনো বল নেই?’
‘না।’
‘স্যার, এই চার প্রকার বল ছাড়া পৃথিবীতে আরও এক প্রকার বল আছে, যা মানুষকে শাসন করে।’
স্যার মুচকি হেসে বলেন, ‘সত্যি?’
‘জি, স্যার। আমি আবিষ্কার করেছি।’
‘এত দিন পর আমি তাহলে একজন বৈজ্ঞানিক ছাত্র পেলাম। তা বলো, তোমার এই পঞ্চম বলের নাম।’
‘যেহেতু এটা মানুষের মনের মধ্যে থাকে। মনের ব্যাপার। তাই এর নাম দিয়েছি মনস্তাত্ত্বিক বল। ইংরেজিতে হয় সাইকোলজিক্যাল ফোর্স।’
‘তা বৈজ্ঞানিক সাহেব, একটি উদাহরণ দিলে আরও ভালোভাবে বুঝতাম। বৈজ্ঞানিক সূত্রের সঙ্গে উদাহরণ দিতে হয়।’
‘একটি ছেলে ও একটি মেয়ের মধ্যে এই বল ক্রিয়া করে। যেমন আমাদের ক্লাসের মোতালেব ও বিলকিসের মধ্যে এই বল কাজ করে। তারা দুজন পাশাপাশি থাকতে চায়। তা ছাড়া একজন দূরে গেলে অন্যজন টান অনুভব করে। এই বলের ধর্ম মহাকর্ষ বলের উল্টো। যত দূরে যাবে, টান তত বাড়বে।’
‘এটা কোনো প্রমাণ হলো?’
‘স্যার, বস্তুগত প্রমাণ আছে। মোতালেবের ব্যাগের মধ্যে পদার্থবিজ্ঞানের বই নেই। সব কবিতার বই। ও বলে, পদার্থবিদ্যা দিয়ে মহাবিশ্ব বোঝা যায়, মানুষের মন বোঝা যায় না। মানুষের মন বুঝতে হলে কবিতা পড়তে হবে।’
স্যার থমথমে গলায় বললেন, ‘তুমি এখন যাও। পরে এ নিয়ে কথা বলব।’
ছয়·
পরের দিন দেখি, স্যার রেগে বোমা হয়ে আছেন। স্যার আমাকে বললেন, ‘মোতালেবের ব্যাগ খুলে চেক করো?’
আমি ব্যাগ খুলি। সব কবিতার বই। কোনো পদার্থবিদ্যার বই নেই।
স্যার বললেন, ‘এগুলা কী? কবিতা লিখবা। মজনু হইবা। মজনুগিরি আমার ডিপার্টমেন্টে চলব না।’
মোতালেব ক্লাস ত্যাগ করার সময় বলল, ‘স্যার, আমি মহাবিশ্ব না, মানুষের মন বুঝতে চাই।’
আমার এই যুগান্তকারী পঞ্চম বল আবিষ্কারের ফলে মোতালেব পদার্থবিদ্যা ছেড়ে আর্টসে চলে গেল সাহিত্য পড়তে। সঙ্গে বিলকিসও!
— আব্দুল্লাহ আল মামুন
খুন্না, ওসমান মঞ্জিল, হিজলা, বরিশাল।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০১, ২০০৯
Leave a Reply