একবার মার্ক টোয়েন এক লেকচার ট্যুরে গেছেন। এক শহরের একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করবেন তিনি। শহরের এক ক্ষৌরকারের দোকানে দাড়ি কামাতে ঢুকলেন। কথা প্রসঙ্গে ক্ষৌরকার জানতে পারলেন, ওই শহরে মার্ক টোয়েনের এটাই প্রথম সফর। তখন সে উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন, ‘আপনি খুব ভালো সময়ে এখানে এসেছেন, স্যার।’
‘তাই বুঝি?’ কৌতূহলী হলেন মার্ক টোয়েন, ‘কেন বলো তো?’
‘মার্ক টোয়েন আজ রাতে এখানে বক্তৃতা করবেন। আপনি নিশ্চয়ই তাঁর কথা শুনতে যাবেন?’
‘মনে হচ্ছে যাব···।’
‘তা, টিকিট করেছেন?’
‘না, এখনো করিনি।’
‘আরে, করেছেন কী! সব টিকিট তো বিক্রি হয়ে গেছে! হয়তো ঢুকতে পারবেন ভেতরে, কিন্তু পুরোটা সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।’
মার্ক টোয়েন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘এটাই আমার নিয়তি। ওই ভদ্রলোক যখনই বক্তৃতা করেন, আমাকে দাঁড়িয়েই থাকতে হয়।’
মুখে যা-ই বলুন না কেন, বক্তৃতা দেওয়ার সময় এই দাঁড়িয়ে থাকা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না টোয়েনের। তাঁর কলমে যেমন শব্দের মুক্তা ঝরত, তেমনি মুখে ফুটত কথার খই। আর সিগার ফুঁকায় তাঁর জুড়ি ছিল না। ঘুম থেকে চোখ মেলে তিনি সেই সিগার ধরাতেন; ঘুমানোর আগ পর্যন্ত একটার পর একটা সিগার জ্বলতে থাকত তাঁর দুই আঙ্গুলের ফাঁকে।
টোয়েনের বন্ধু ঔপন্যাসিক উইলিয়াম ডিন হাওয়েলস তাঁর এ দিনভর ধূমপানের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। ্নৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘টোয়েনের এই বদ-অভ্যাস অনেকেই সহ্য করতে পারত না। এমনকি তাঁর স্ত্রী অলিভিয়াও এ নিয়ে প্রায়ই তাঁর সঙ্গে মেজাজ দেখাতেন। টোয়েন কখনো আমাদের সঙ্গে কয়েকটা দিন থাকলে সারাক্ষণ বাড়ি তামাকের কটু গন্ধে ভারী হয়ে থাকত। সকালে নাশতার টেবিল থেকে সেই যে তাঁর সিগার ফুঁকা শুরু হতো, রাতে ওই ফুঁকতে ফুঁকতেই ঘুমাতেন তিনি। একবার তো আগুনই ধরতে যাচ্ছিল। দেখি, বিছানায় তিনি ঘুমে বিভোর, অথচ আঙ্গুলের ফাঁকে তখনো সিগার জ্বলছে।’ টোয়েনকে পরামর্শ দেওয়া হলো, ‘ধূমপান করবে ভালো কথা, একটু রয়ে-সয়ে করো।’
এতে বিরক্ত হয়ে তিনি বলেন, ‘কী যে বলো না তোমরা! আমি তো প্রতিবার শুধু একটা সিগারই টানি!’
তরুণ বয়সে ভার্জিনিয়া সিটিতে একদিন টোয়েন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন; তাঁর বগলে একটি সিগারের বাক্স গোঁজা। এমন সময় পরিচিত একজনের সঙ্গে তাঁর দেখা। তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘এ কী দেখছি, টোয়েন! আপনি না ধূমপান করবেন না বলে আমার সঙ্গে ওয়াদা করেছেন! এখন দেখছি গোটা এক সিগারের বাক্স নিয়ে যাচ্ছেন?’
টোয়েন ঠোঁট বাঁকা করে হেসে বললেন, ‘সিগারের বাক্স আমি নিয়ে যাচ্ছি কোথায়! এ বাক্সই তো বরং আমাকে ঠেলছে!’
টোয়েনের একটা স্বভাব ছিল শোনা কথায় বিশ্বাস করা এবং কোনো কিছু না ভেবেই সিদ্ধান্ত নেওয়া। একবার তিনি শুনতে পেলেন এক মেহনতি তরুণ একটি কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছেন। কোম্পানির সামনের ফুটপাত থেকে ছড়িয়ে পড়া আলপিন বেশ ধৈর্যের সঙ্গে কুড়ান তিনি। তাঁর এ ধৈর্য দেখে ওই কোম্পানির কর্তা মুগ্ধ হয়ে তাঁকে এ চাকরি দেন। এ গল্পে মজে টোয়েন ভাবলেন, যাই, আমিও ওই কোম্পানিতে চাকরি বাগাই।
কী করলেন টোয়েন? কিছু আলপিন ছড়িয়ে দিলেন ওই ফুটপাতে। তারপর ধীরেসুস্থে একটা একটা করে আলপিন কুড়াতে লাগলেন। শিগগিরই কোম্পানির এক কর্মী এসে ধমক দিলেন তাঁকে, ‘এই মিয়া, যাও, ভাগো। তোমার কাণ্ড দেখতে গিয়ে কোম্পানির কর্মীদের কাজে মন বসছে না। এতে আমাদের কর্তা খুব খেপেছেন।’
আরেকবার টোয়েন এক অনুষ্ঠানে গেছেন। সেখানে একটা তহবিলের জন্য টাকা তোলা হচ্ছিল। শুরুতে টোয়েন ভাবলেন, এটা মহৎ কোনো উদ্যোগ। কাজেই দান করার জন্য ১০০ ডলারের একটা নোট বের করলেন তিনি। যে টাকা তুলছিল, একটানা বকে যাচ্ছিল সে। এতে ধৈর্যচ্যুতি ঘটে টোয়েনের। চট করে টাকার অঙ্ক অর্ধেকে নামিয়ে আনেন তিনি। আরেকটু সময় গড়ালে তিনি ১০ ডলারের নোট বের করেন। শেষে তহবিলের ঝুড়িটা যখন তাঁর সামনে আসে, তিনি তখন এক ডলারের একটা নোট ছেড়ে দেন তার ভেতর।
মার্ক টোয়েন বেশির ভাগ লেখা বিছানায় শুয়ে লিখেছেন। একদিন তিনি শুয়ে শুয়ে লিখছেন এমন সময় তার স্ত্রী এসে জানালেন, একজন সাংবাদিক এসেছেন তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে। কিন্তু টোয়েন এতে কোনো গা করলেন না। স্ত্রী তখন রেগে গিয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার, উঠছ না কেন, ভদ্রলোক তোমাকে বিছানায় এ অবস্থায় পেলে তা কি অস্বস্তিকর হবে না?’
টোয়েন অবলীলায় বলেন, ‘এ বিছানা যদি তোমার পছন্দ না হয়, তাহলে আরেকটি বিছানা করে দাও না। সেখানেই না হয় আমার সাক্ষাৎকার নেবে সে।’
মার্ক টোয়েনকে একবার প্রশ্ন করা হলো, ‘নারীহীন কোনো ভুবন পুরুষদের জন্য কেমন হবে বলুন তো?’ তিনি চট করে জবাব দেন, ‘আরে ভাই, তেমন ভুবন পেলে তো!’
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২৫, ২০০৯
Leave a Reply