লীনা আর লতিফের বিয়ে হয়ে গেল সেদিন।
লীনা ইঞ্জিনিয়ার জব্বার সাহেবের মেয়ে। আর লতিফ? সেই যে একহারা সুশ্রী চেহারার ছেলেটি। বিলেত না আমেরিকা থেকে দু-দুুটো পাস দিয়ে সবে এসে সেক্রেটারিয়েটে ঢুকেছে। বিয়েতে গিয়ে দেখি, প্রেজেন্টের যেন পাহাড় বনে গেছেঃ ঘড়ি, শাড়ি, বই, গয়না-মোট কথা, সুশ্রী সুন্দর আরামদায়ক আধুনিক রূপসজ্জার যা কিছু কল্পনা করা যেতে পারে, কিছুই বাদ পড়েনি।
যাক, বিয়ে তো হয়েই গেল এবং লীনা-লতিফ এক নতুন বাসায় গিয়ে উঠল। বেশ সুন্দর বাসাটি। সামনে একখানা বাগানের মতো। পেছনটা খোলা। হুহু করে বাতাস বইছে সারা দিন। বড্ড স্বাস্থ্যপ্রদ জায়গাটা। তবে তারা বড্ড একলা পড়ে গিয়েছিলঃ চাকরবাকর তখনো জোগাড় করে উঠতে পারেনি।
এমনই সময় হঠাৎ একদিন এমন একটা কাণ্ড ঘটে গেল, যা সত্যি ভোলার নয়।
সেদিন সকালে চা খাবার আগে লতিফ বসে শেভ করছিল। তাকে নাকি তাড়াতাড়ি সেক্রেটারিয়েটে যেতে হবে। জরুরি একটা কাজ আছে। ডাকপিয়ন সামনে একখানা খাম ফেলে দিয়ে চলে গেল। ঈষৎ নীলাভ খামখানাঃ দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। তাতে গোটা গোটা অক্ষরে লীনা-লতিফের নাম লেখা। লতিফ ভাবে, আমাদের বিয়ে তো হয়ে গেল সেদিন। এ আবার কার বিয়ের চিঠি? লতিফের ডান হাতখানা তখনো শেভিংয়ে ব্যস্ত। বাঁ হাতে খামের কভারটা খুলে সে একটুখানি দেখল। ততক্ষণে লীনাও এসে বসে পড়েছে পাশে। লতিফ বলল, ‘দেখ তো, চিঠিপত্র নেই, এ কেমন ধরনের খাম।’ লীনা খামের মধ্যে আঙ্গুল গলিয়ে বলল, ‘কী যেন দুটো কাগজের টুকরোর মতো ঠেকছে।’ সঙ্গে সঙ্গে লীনা যে দুটো জিনিস টেনে বার করল, বিয়ের রাজ্যে এমন প্রেজেন্ট কেউ আজ পর্যন্ত কাউকে দেয়নি। বা রে! এ যে দুটো সিনেমার টিকিট! কে যেন পরম যত্নে অ্যাডভান্স বুকিং করে পাঠিয়ে দিয়েছে। আজকেই সন্ধ্যা ছয়টার শো। গুলিস্তানে। ড্রেস সার্কেল। অবশেষে খামখানা আরও একটু ভালো করে ঝাড়া দিতেই ছোট্ট একখানা ্লিপও বেরিয়ে পড়ল। তাতে লেখাঃ ‘লীনা-লতিফ, তোমাদের বিয়েতে শরিক হতে না পেরে বড়ই দুঃখিত। তাই ডাকযোগে এ দুটো ক্ষুদ্র উপহার প্রেরণ। যদিও নিতান্তই সামান্য, আশা করি গ্রহণে কুণ্ঠিত হবে না। প্রার্থনা করি তোমাদের মধুচন্দ্রিমা মধুর হোক।
‘ইতি, তোমাদের নাম না জানা বন্ধু’ (নাম জানতে চেয়ে লজ্জা দিয়ো না)।
বি্নয়ে-আনন্দে লীনা-লতিফ কতক্ষণ কোনো কথাই বলতে পারল না। বিয়ের প্রেজেন্ট তারা বহু পেয়েছে, বহু দিয়েছে। কিন্তু সিনেমার টিকিটের মাধ্যমে এমন অবাক করা বিয়ের প্রেজেন্ট! ওঃ, এ যে রীতিমতো স্বপ্নের মতো সুন্দর! তাই তারা তখনই ঠিক করে ফেললঃ এ ছবি তারা দেখবেই।
কিন্তু একটা বিষয়ে তাদের মনে ক্ষোভ থেকে গেল। কে এই অবাক করা বন্ধু, শুধু দানই করে গেল কিন্তু জানতে দিল না, কে সে?
সুতরাং লীনা-লতিফের খুব খারাপ লাগল, সারাটা দিন তাদের আর কোনো কাজে মন বসল না। লতিফ তাড়াতাড়ি অফিসে গিয়েছিল সত্যি, কিন্তু তাড়াতাড়িই তাকে ফিরে আসতে হলো। অফিসের কোনো কাজে আজ তার মন বসেনি। এদিকে সিনেমার তখনো অনেক দেরি। লীনা কাপড়চোপড় পরে আগেভাগেই তৈরি হয়ে বসে আছে। লীনার মনে মনে বিশ্বাস, যতই নাম ঢাকুক না কেন, ভদ্রলোক সিনেমার হলে নিশ্চয়ই একবার দেখা দেবেন। তাই চা ঢালতে ঢালতে লীনার প্রস্তাবঃ ‘চিঠিখানা আরও একবার ভালো করে দেখলে হয় না? হয়তো ভদ্রলোক নাম-ঠিকানা সবই দিয়েছেন। আমরা খেয়াল করিনি।’ লতিফ বলে, তাই হোক। ্লিপখানা এনে তারা উল্টেপাল্টে অনেকক্ষণ দেখল। কিন্তু নাম-ঠিকানা কিছুই পাওয়া গেল না। হঠাৎ হস্তাক্ষরটা দেখে লতিফের একটা কথা মনে পড়লঃ ‘লীনা, এসব মুস্তাফিজের কারসাজি নয় তো?’
মুস্তাফিজ ছিল লীনা-লতিফের ছেলেবেলার খেলার সাথি। সেই যে সেবার স্কুল পালিয়ে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হলো। আহা! বেচারা! তারপর আজ ২০-২২ বছর দেখা-সাক্ষাৎ নেই। লতিফ শুনেছে, ইতিমধ্যে সে নাকি এক বিরাট কারবারের মালিক হয়ে বসেছে এবং বিয়ে-শাদিও করেছে।
লতিফ বলল, ‘আচ্ছা, ছিঁড়ে ফেলা খামখানা আবার আনো তো দেখি। ছেঁড়া খামখানা এনে ওরা দুজন অনেকক্ষণ পরীক্ষণ-নিরীক্ষণের কাজ চালাল। গোটা গোটা অক্ষরে লীনা আর লতিফের নাম স্পষ্ট করে লেখা। ্লিপখানায়ও গোটা গোটা হরফ। ক্রমশ লতিফের সন্দেহ বেড়ে যায়ঃ ‘তাই তো! এমন ধারা গোটা গোটা অক্ষরে মুস্তাফিজই তো একমাত্র লিখত তাদের ক্লাসে।’ লীনারও সন্দেহ অনুরূপ। শেষে লতিফ আর থাকতে পারল নাঃ ‘না হে, আমার আর বুঝতে বাকি নেই। এ মুস্তাফিজেরই কীর্তি।’ তারপর তারা মুস্তাফিজকে স্মেহের গাল দিতে দিতে মনে মনে ঠিক করে রাখল, যদি কোনো দিন মুস্তাফিজের সঙ্গে দেখা হয়, তবে আর রক্ষে নেই।
রাত নয়টায় ছবি দেখে যখন তারা বাসায় ফিরল, এমন নির্মল আনন্দে মনপ্রাণ ভরে গেল যে সে আর বলার নয়! ওঃ, কী মনমাতানো ছবিখানা! যেমন গেটআপ, তেমনি প্রযোজনা, অ্যাক্টিং, গান, সংলাপ, টেকনিক, প্লট! সব। একেবারে অনবদ্য! সত্যি এমন রুচিসম্পন্ন একজন বন্ধু যে এতক্ষণ নির্দয়ের মতো গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে পারে, ভাবতেও লীনার রাগ ধরে যায়ঃ ‘কই, সিনেমার কক্ষেও তো ভদ্রলোক একবার এসে দেখা দিতে পারতেন। দিলে কী ক্ষতি হতো তাঁর?’ ইত্যাদি। ইত্যাদি। লতিফ বলল, ‘লীনা, ওসব ভেবে আর কী লাভ? এখন খাবারের জোগাড় করা যাক। রাত যে প্রায় ১০টা। কাজেই লীনা খাবার জোগাড় করবে বলে ভেতরে চলে গেল এবং সুইচ টিপল। তার পরেই এক বুকফাটা চিৎকার!
লতিফ দৌড়ে গেল।
গিয়ে দেখে, লীনা প্রায় বেহুঁশের মতো পড়ে আছে, আর ঘরে চেয়ার-টেবিলগুলো সব ওলট-পালট। পেছনের দরজাখানা খোলা, আর জানালার শিকগুলো ভাঙা। কে যেন তাদের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিয়ের প্রেজেন্টগুলোসহ দামি দামি গয়নাগাটি নিয়ে ভেগে পড়েছে। সবসুদ্ধ ৫০ হাজার টাকার মাল!
এমন সময় দেখা গেল আর একখানা ছোট্ট ্লিপ, সেই রকমেরই গোটা গোটা অক্ষরে লেখা। তাড়াতাড়ি ্লিপখানা কুড়িয়ে নিয়ে লীনা-লতিফ পড়তে বসে গেল।
“লীনা-লতিফ,
প্রথমত, আমার ভালোবাসা নিয়ো।
হ্যাঁ, তোমাদের ভালোবাসা সত্যি ভালো! এমন ভালোবাসাতে তো আর যা তা ধরনে প্রবেশ করা চলে না। তাই ঠিক করা গেলঃ ‘টিকিট কেটে সিনেমায় পাঠানো যাক।’ আশা করি ছবিখানা দেখে প্রচুর আনন্দ পেয়েছ। যেমন আমিও আনন্দ পেলুম তোমাদের বাসাখানাকে শূন্য করে।
হ্যাঁ, সত্যি তোমাদের দারুণ ভালো বাসা! আজ তবে আসি। সাবধানে থেকো। ইতি।”
সাজেদুল করিম, শিশুসাহিত্যিক। জন্মঃ ১৯১৭, মৃত্যুঃ ১৯৯৫।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২৫, ২০০৯
Leave a Reply