একদা এক ভদ্রলোকের স্ত্রী মারা গেলেন। তাঁর একটি মাত্র মেয়ে। মেয়ের নাম তোমা। এই সময়ে এক ভদ্রমহিলারও স্বামী মারা গেলেন। তাঁরও একটি মাত্র মেয়ে। নাম দুসিয়া।
একদিন বিপত্নীক ভদ্রলোকটি ওই বিধবা মহিলাকে বিয়ে করলেন। অতএব, তোমা হলো ওই বিধবার সৎ মেয়ে এবং সে কারণেই সাবেক বিধবাটি হলেন সৎমা।
তার পরই গোলমাল শুরু হলো।
অবশ্য আজকালকার সৎমায়েরা আগেকার রূপকথার সৎমায়েদের মতো নিষ্ঠুর হন না তেমন। তবে নিয়মের হেরফের সব ব্যাপারেই দেখা যায়। এই যেমন তোমা’র সৎমায়ের ব্যাপারে।
তোমা’কে প্রথম দেখেই সৎমায়ের মনটা বিষিয়ে উঠল। ঠিক করলেন, মেয়েটার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলবেন। কিন্তু সেটা করবেন কায়দা করে। খোলাখুলি কিছু করার মতো বোকা তিনি নন। কারণ পেটে তাঁর বিদ্যা আছে, মাথায় বুদ্ধিও।
তা ছাড়া ওই সৎমায়ের অনেক রূপকথাও পড়া আছে। সিন্ডিরেলার গল্পও তিনি পড়েছেন। তাঁর বেশ মনে আছে, সিন্ডিরেলার সৎমা তাকে কষ্ট দিলেও সে দিন দিন রূপে-গুণে সবাইকে মুগ্ধ করে; এমনকি শেষ পর্যন্ত এক রাজপুত্র এসে তাকে বিয়ে করে নিয়ে যায় (রূপকথার রাজপুত্তুরেরা কষ্ট পাওয়া গরিব মেয়েদের বিয়ে করে তাদের উদ্ধার করার জন্য যেন মুখিয়ে থাকে)।
তোমা’র সৎমা তাই ঠিক করলেন, একটু সাবধানে কাজ হাসিল করতে হবে। তা ছাড়া তাঁর নতুন স্বামী; তাঁরও রূপকথার গল্প পড়া আছে নিশ্চয়ই। আর বিয়ের সময় রেজিস্ট্রারের সামনে তো স্পষ্টই বললেন তাঁকে, ‘দেখো, আমার মেয়ে তোমাকে আদরযত্ন করতে হবে। তা না করলে তোমাকে ডিভোর্স করব।’
দিন যেতে লাগল। তোমা দিন দিন সুন্দরী হয়ে উঠল। দিন দিন নয়, যেন ঘণ্টায় ঘণ্টায়। আর যেন ঠিক সেই তালে তালেই তার সৎমা হতে লাগলেন হিংসুটে।
শেষে সৎমা ভেবেচিন্তে গেলেন এক যোগীবাবার কাছে। আজকালকার দিনে কেউ আর তুকতাক বিশ্বাস করে না বলে যোগীবাবার পসার তেমন নেই। আর যা-ও বা তুকতাক জানেন, তা-ও সব সেকেলে ধরনের।
যোগীবাবা বললেন, এক কাজ করো। ওকে কোনো কাজে সমুদ্রের তলায় পাঠিয়ে দাও। সেখানে সমুদ্রের রাজা আছেন, তিনি তাকে দেখলেই গিলে খাবেন।
-যাহ্! এটা হয় নাকি।
-তবে এক কাজ করো, ওকে দিন-রাত খাটাও।
সৎমায়ের এসব কিছুই পছন্দ হলো না। রুশ আইনে কাউকে দিন-রাত খাটানোর নিয়ম নেই। তা ছাড়া পাড়ার লোকজনই বা কী বলবে? আর ব্যাপারটা জানাজানি হলে কাগজে উঠতে কতক্ষণ। তখন?
দূর ছাই! যোগীবাবা কোনো মতলবই দিতে পারলেন না। সৎমা বাড়ি যেতে যেতে ভাবতে লাগলেন কী করা যায়।
পরের দিন সকালে উঠে দেখেন, তাঁর মেয়ে দুসিয়া আর তাঁর স্বামীর মেয়ে তোমা তাঁদের ঘরে কম্বল মুড়ি দিয়ে দিব্যি ঘুমোচ্ছে।
সৎমা ঘরে ঢুকেই তাঁর মেয়ের গায়ের কম্বলটা টেনে খুলে দিয়ে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলেন, ‘এই দুসিয়া, ওঠ শিগগির। আমার সঙ্গে কাজ করবি আয়। এখনই তোর বাবার জন্য, বোনের জন্য সকালের খাবার তৈরি করতে হবে।’
মায়ের ধাক্কায় দুসিয়া উঠে বসে বলল, ‘তুমি মা ভুল করছ। তুমি বোধ হয় তোমা’কে ডাকতে গিয়ে আমাকে ডাকছ। আমি তো তোমার নিজের মেয়ে!
-জানি জানি। এখন ওঠ দিকি ছুঁড়ি!
-কী যে বল তুমি মা, তার ঠিক নেই। আমার নরম হাত দুটোকে শক্ত ঝামা করতে চাও নাকি? মা, লক্ষ্মীটি-
-না, না, তুই আয়, খাবার করবি।
-আর তোমা?
-তোমা শুয়ে থাক। ঘুমোক একটু। বেচারা কাল রাতে একটুও ঘুমোতে পারেনি।
কাজেই দুসিয়াকে উঠতে হলো, মায়ের সঙ্গে কাজে লাগতে হলো। আর তোমা বিছানায় পড়ে ঘুমোতে লাগল অনেক বেলা পর্যন্ত। তোমা যখন বিছানা ছেড়ে চোখ রগড়ে উঠল, তখন দেখে তার স্কুলের বেলা হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি নাকে-মুখে গুঁজে ছুটল স্কুলের দিকে।
এমন করেই রোজ তার স্কুলের বেলা হয়ে যেতে লাগল। আর দেখা গেল, স্কুলের অঙ্কগুলো না পারলে তার সৎমা এসে সেগুলো তার হয়ে কষে দিতে লাগলেন। তোমা ভাবল, সত্যি তার সৎমা কী ভালো!
আর ওদিকে দুসিয়া বাড়ির ধোয়াধুয়ি মাজামাজি-সব কাজ করতে লাগল মায়ের বকুনির ভয়ে।
সৎমা একদিন স্বামীকে বললেন, দেখো তোমা’র রোজ স্কুলে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। একটা গাড়ির ব্যবস্থা করা দরকার। সে জন্য যদি দরকার হয়, অফিস থেকে ধার নেওয়াও উচিত।
এদিকে দুসিয়া যদি স্কুলে অঙ্ক না পারে, অমনি মায়ের কাছে বকুনি খায়, ‘নিজে কষার চেষ্টা করো।’
তা ছাড়া সব কাজ দুসিয়ার ঘাড়ে। অসুখ হয়েছে, যা, ডাক্তার ডেকে আন; দুধটা নিয়ে আয় তো ইত্যাদি।
আর তোমা? কুটোগাছটাও নাড়ায় না। আর নড়াচড়া না করায় তোমার তেমন খিদেটিদেও হয় না। শরীরটাও কেমন দুর্বল মনে হয়। চেহারাটাও দিন দিন ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে।
ক্রমে তোমা বেশ মোটা হয়ে পড়ল। গাল-টাল ভারী হয়ে গেল। সৎমা তাকে জোরজার করে ভালো-মন্দ মণ্ডা-মিঠাই খাওয়াতে লাগলেন। ক্রমে তোমার এমন অবস্থা হলো যে সে নড়ে বসতে পারে না, একটুতেই হাঁপিয়ে পড়ে।
এদিকে পাড়ায় সৎমায়ের কী প্রশংসা! অমন ভালো সৎমা দেখাই যায় না। বাপও খুব খুশি। সংসারে অশান্তি নেই, মেয়েটাও খুব যত্নে আছে। স্বাস্থ্যটাও বেশ ফিরেছে তার। কিন্তু কেউই বুঝতে পারলেন না সৎমায়ের মতলবটা-তিনি তাঁর নিজের মেয়েকে কাজে আর লেখাপড়ায় খুব ভালো করে তুলেছেন, আচার-ব্যবহারও শেখাচ্ছেন ভালোই। আর সৎমেয়েটাকে কুঁড়ে আর অকম্মার ঢেঁকি করে তুলছেন।
গল্পটাকে বেশি না ফেনিয়ে বলি, একদিন তোমার বাপ ভদ্রলোক অসুখে পড়লেন। চিকিৎসক এসে দেখে ওষুধপথ্যের ব্যবস্থা করে বললেন, স্ট্রবেরি ফলটা খাওয়া এ সময় খুব উপকারী। কিন্তু ডিসেম্বর মাসে স্ট্রবেরি কোথায় পাবে?
দুসিয়া বলল, মা, আমি বনের মধ্যে একবার দেখি, সেখানে স্ট্রবেরি পাওয়া যেতে পারে হয়তো। অনেক গল্পে পড়েছি। ভাগ্য যদি ভালো হয়, তবে কোনো জিনিস বনের মধ্যে খোঁজ করলে সেটা পাওয়া যায়। একবার দেখি।
বনের মধ্যে স্ট্রবেরি খুঁজতে গিয়ে দুসিয়ার সঙ্গে দেখা হলো এক অপূর্ব সুন্দর ছেলের। তার নাম ভাস্যা। অনেক কষ্টে স্ট্রবেরি নিয়ে ফেরার পথে ভাস্যা দুসিয়াকে তার বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিল। দুসিয়ারও বেশ ভালোই লাগল ভাস্যাকে। তার বাপ-মায়েরও বেশ ভালো লাগল ছেলেটিকে-বেশ ভদ্র, শিক্ষিত, দেখতেও বেশ। ওর সঙ্গে দুসিয়ার বিয়ে দিলে কেমন হয়?
এবং তা-ই হলো। দুসিয়ার সঙ্গে ভাস্যার বিয়ে হলো।
এই বিয়েতে তোমা হিংসায় জ্বলে উঠল। সেও ঠিক করল বনে যাবে। সেখানে গিয়ে সেও দুসিয়ার মতো শিক্ষিত সুন্দর বর খুঁজে আনবে।
তোমা কাউকে কিছু না বলেই বনে গেল। আর সেখানে সে গেল এক নেকড়ের পেটে।
না, না। এটা বানিয়ে বললাম। তোমা নেকড়ের পেটে যায়নি। কারণ সে বনেই যায়নি। যাবে কী করে? তার ওই মোটা শরীর নাড়াতেই অস্থির সে।
লাজার ল্যাগিন
অনুবাদঃ কুমারেশ ঘোষ
লাজার ল্যাগিন : রাশিয়ান রম্য লেখক। অনেক বই লিখেছেন রঙ্গব্যঙ্গের। ছোটদের জন্যও অনেক লিখেছেন। প্রাভদা থেকে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত বই অফেনসিভ টেলস ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ১৮, ২০০৯
Leave a Reply