প্রতি পাঁচ বছর পর সরকার পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি কী?
ক· নতুন উন্নয়নের খাত তৈরি হয়।
খ· জনগণ নতুন করে স্বপ্ন দেখে।
গ· জনগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
ঘ· দেশ পাঁচ বছর এগিয়ে যায়।
আসলে এটি একটি কনফিউজিং প্রশ্ন। উত্তর ওপরের একটিও নয়। প্রাপ্তি একটাই-বিগত সরকারের দুর্নীতি, অপরাধ আর লুটপাটের সঠিক একটা বিবরণ পাওয়া যায়। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে বলেছে, আওয়ামী লীগ দেশ চেটেপুটে শূন্য করে দিয়েছে। এবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর একে একে বেরিয়ে আসছে বিএনপির থলের বিড়াল। (অবশ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও অনেক বিড়াল বেরিয়েছিল সবার থলে থেকে। এখন আরও বের হচ্ছে। এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর থলেতে যে কত বিড়াল থাকে, সেটা বোধহয় তারা নিজেরাও জানে না।) কবিতাটি যদি এমন হয়-এক সরকার চলে যায় রেখে যায় ্নৃতি/নতুন সরকার এসে দেখে শুধু দুর্নীতি!
গত দুই বছর জরুরি অবস্থায় কোনো রাজনৈতিক সরকার না থাকলেও এ জমিতে একজন সরকার ছিলেন। তিনি ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার। বিএনপির সরকারের পূর্ণ মেয়াদ শেষ হলেও এ সরকারের তখনো মেয়াদ শেষ হয়নি। সরকার ছিলেন, তাই ব্যয়ও ছিল; সরকারি ব্যয় যাকে বলে! সংসদে কোনো সাংসদ না থাকলেও কাল্পনিক সাংসদদের জন্য রাষ্ট্র থেকে মাত্র ৫৪ লাখ টাকার ওষুধ কেনা হয়েছে। আর মাত্র ৫০ লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে সংসদীয় প্রতিনিধিদলের বিদেশ সফরের জন্য, বলে অভিযোগ উঠেছে। এই সফরগুলোতে এক দলে বেশির ভাগ সময় স্পিকার নিজেই ছিলেন এবং অন্য দলে ছিলেন তাঁরই ডেপুটি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সাবেক সাংসদদের জন্য বিশাল বরাদ্দ দেওয়া হয়, ব্যাপারটা কেমন ভৌতিক না?
বিগত বিএনপির সরকারের ভেতরই বাস করতেন এই সরকার। একসঙ্গে একটা হাতি পালা যায়, দুটো পালতে গেলে খরচের দড়ি মানে না। দেখুন সংসদের খাতাপত্র কী বলছে, জমিরউদ্দিন সরকার কেবল তাঁর বাসা সাজানোর জন্য ২০০২-০৩ অর্থবছরে রাষ্ট্র থেকে নিয়েছেন ১২ লাখ ২৬ হাজার ৮৪৪ টাকা। কিন্তু মাত্র ছয় বছরের মাথায় গত কয়েক দিন আগে তাঁর ২১ বেইলি রোডের বাসায় কোনো ফার্নিচারই পাওয়া যায়নি, ওগুলো নাকি নষ্ট হয়ে গেছে! প্রশ্ন আসে, ১২ লাখ টাকায় উনি এমন কোন কাঠের ফার্নিচার কিনেছেন যে ছয় বছরেই নষ্ট হয়ে গেল! এ ছাড়া ক্ষমতায় থাকার সময় প্রতিবছর তিনি বাসায় গাছপালা লাগানোর নামে নিয়েছেন এক লাখ টাকা করে। একবার ভাবুন তো, এক লাখ টাকার গাছ যদি রাস্তার পাশে লাগানো যেত, কত কিলোমিটার রাস্তায় গাছ লাগানো যেত? এ ছাড়া অভিযোগ উঠেছে ২০০৩-০৪ সালে বিদেশে চিকিৎসা বাবদ নিয়েছেন প্রায় ২০ লাখ আর ২০০৬-০৭ সালে নিয়েছেন প্রায় ২৮ লাখ টাকা মাত্র। এমনিতেই ফি-বছর রাষ্ট্র থেকে তাঁর জন্য চিকিৎসার খরচ বাবদ বরাদ্দ থাকত আড়াই লাখ টাকা! গ্রামে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে, নাপিত দেখলেই চুল কাটাতে ইচ্ছে করে। আমাদেরও বোধহয় রাষ্ট্রীয় টাকা দেখলে খরচ করতে ইচ্ছে হয়। খুব জানতে ইচ্ছে করে, ক্ষমতায় আসার আগে তিনি কতবার বিদেশে গিয়ে এত টাকা ব্যয় করে চিকিৎসা করিয়েছেন? ব্ল্যাকহোলের নাম নিশ্চয় সবাই শুনেছি। আমাদের ক্ষমতাবানেরা হলেন একেকজন হিউম্যান ব্ল্যাকহোল, রাষ্ট্রের যেকোনো সম্পদই তাঁরা গিলে হজম করতে পারেন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই। সেখানে ১০-১২ লাখ টাকার ফার্নিচার, ৫০-৬০ লাখ নগদ টাকা তো মামুলি বিষয়। সে দিক থেকে ডেপুটি স্পিকার সরকারি অর্থের অনেক কম শ্রাদ্ধ করেছেন। খুব সম্ভবত তাঁর নামের শেষে সরকার নেই বলে খরচের লাগাম ছিল। তিনি শুধু একবার সরকারি বরাদ্দের আড়াই লাখ টাকার পর সোয়া এক লাখ টাকা অতিরিক্ত নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ আছে।
সরকারি ব্যয়ের কথা বলব অথচ সাবেক চিপ হুইপ খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের কথা বলব না, তা কি হয়! আগে একটা সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ! ওনি সেদিন এক তদন্তকারী কর্মকর্তাকে শাসিয়ে বলেছেন, অভিযোগ আনলে সঠিক অভিযোগ আনতে হবে। তখন ওই কর্মকর্তা ২০০৬ সালে সিঙ্গাপুরে তাঁর চিকিৎসা বাবদ ছয় লাখ টাকা ব্যয়ের কথা ওঠালে তিনি বলেন, চিকিৎসা বিষয়টা খুবই মানবিক। নিজের পেটের অপারেশনের দাগের কথাও ্নরণ করিয়ে দেন কর্মকর্তাকে। চিকিৎসার জন্য তিনি রাষ্ট্র থেকে কিছু টাকা বেশি নিতেই পারেন, রাষ্ট্রের এত বড় একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁকে তো আর চিকিৎসাহীন রাখা যায় না! চলুন একটু পেছনে ফিরে যাই। আগেই তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোর দিকে চোখ বুলাই। খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন সাহেব, চিফ হুইপ থাকাকালে সংসদের ক্যান্টিন থেকে নিয়ম না থাকা সত্ত্বেও বহুদিন দুই বাসার নামে যে চাল-ডাল-তেল-নুন, আলু, পিঁয়াজ, আদা, জিরা, গোলমরিচ-তেজপাতা-পাঁচফোড়ন, ঘি, গুঁড়ো দুধ, বিস্কুট থেকে শুরু করে লাখ লাখ টাকার খাদ্যদ্রব্য নিয়ে যেতেন, সেগুলোও কি মানবিক হিসেবে ধরে নেওয়া উচিত? দুই বাসার জন্য ক্যান্টিন থেকে কোন তারিখে কোন পণ্য কতটা নিয়ে যাওয়া হতো পত্রিকায় ছাপা হওয়া সেই ফর্দটা এখনো সবার মনে আছে। যত্ন করে সবাই মনে রেখেছে কারন তিনি যদি আবার কখনো যদি চিফ হুইপ হন, আগেরবার কী কী নিয়েছিলেন সেগুলো তাঁর মনে নাও থাকতে পারে- মানবিকতার বিষয়টি মাথায় রেখেই যেন তখন তাঁকে সেটি মনে করিয়ে দেওয়া যায়।
নির্বাচনের আগে এক প্রার্থী এক যুবকের কাছে ভোট চাইতে আসেন। যুবক সঙ্গে সঙ্গেই প্রার্থীর ইন্টারভিউ নিতে শুরু করেন। প্রার্থী জানতে চান কেন ইন্টারভিউ নেওয়া হচ্ছে। যুবকটি তখন তাঁকে বলেন, ‘আপনাকে দেশ চালানোর মতো এত বড় একটা চাকরি দেব, তার আগে আপনার দেশ চালানোর মতো যোগ্যতা আছে কি না সেটা দেখব না?’ যোগ্যতাটা আসলে কী? লুটপাট করার ক্ষমতা?
তাওহিদ মিলটন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ১৮, ২০০৯
Leave a Reply