সারা পৃথিবীতে ‘ফ্রি’ শব্দটা সবার মাথায় একদম ফ্রি ভাবে ঘোরাফেরা করছে। একটা কিনলে একটা ফ্রি, রিচার্জ করলে এসএমএস ফ্রি, বন্ধ সংযোগ চালু করলে টকটাইম ফ্রি, ফ্রিজ কিনলে টিভি ফ্রি, টিভি কিনলে ডিভিডি ফ্রি-এমন আরও কত কিছু যে ফ্রি দেওয়া হচ্ছে, এর কোনো হিসাব নেই। প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ, আধুনিক যুগের পর এখন চলছে ফ্রি যুগ। এই ফ্রির যুগে সরকার তো আর পিছিয়ে থাকতে পারে না, তাই তারা শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পাঠ্যবই দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিনামূল্যে মানে একদম ফ্রি।
প্রথম থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত সবাই বিনামূল্যে বই পাবে-এটা খুবই আনন্দের সংবাদ। পাঠ্যবই কিনে কেউ দেউলিয়া হয়েছে কি না, এ তর্ক আর চলবে না। তবে পয়সা দিয়ে বই কিনতেই মার্চ মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। বিনামূল্যে দিলে বই পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এর পরও পাঠ্যবই কিনতে কোনো টাকাপয়সা লাগবে না, এটা ভাবতেই কেমন শান্তি শান্তি লাগছে। বইয়ের দাম বেশি-এ কথা ভেবে যে ব্যক্তি তাঁর চার সন্তানের একজনকে স্কুলে ভর্তি করাতেন, তিনি হয়তো চারজনসহ বাসার কাজের ছেলে বা মেয়েটিকেও স্কুলে ভর্তি করাবেন। এতে শিক্ষার ব্যাপক উন্নতি হবে; কিন্তু এ খবরে যাদের খুশি হওয়ার কথা, সেই ছাত্রছাত্রীরাই তেমন খুশি নয়। আমার সপ্তম শ্রেণী-পড়ুয়া ছোট ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, কী রে, তোদের তো পাঠ্যবই ফ্রি দেবে, খুশি লাগছে না? সে গম্ভীর মুখে বলল, খুশি হওয়ার কী আছে? আমি অবাক হয়ে বললাম, খুশি হওয়ার কী আছে মানে? পাঠ্যবইয়ের জন্য কোনো টাকা লাগবে না, এটা খুশি হওয়ার খবর নয়? ছোট ভাই নির্বিকারচিত্তে বলল, আমরা তো পাঠ্যবইয়ের চেয়ে নোটবই বেশি পড়ি। নোটবই যদি ফ্রি দিত, তাহলে হয়তো খুশি হতাম। আমি চমকে উঠলাম। বলে কি! ওর কথার সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে দেখি, আসলেই তাই। নোটবইগুলোর পাতা ছেঁড়া, দাগাদাগিতে ভরপুর। অথচ পাঠ্যবইয়ে ওসবের কোনো চিহ্নই নেই। একেবারে নতুন বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে।
অনেকেই বিনামূল্যে বই দেওয়াটাকে ভালোভাবে নিচ্ছেন না। যেমন আমার খালু। খালুর ধারণা, পাঠ্যবই ফ্রি দেবে কেন? পাঠ্যবই কি গ্লাস না বাটি যে ফ্রি দেবে? এর কোনো দাম নেই নাকি? এত লোক কষ্ট করে বই লিখবে, অথচ তার কোনো দাম থাকবে না, এটা কেমন কথা! তা ছাড়া, ভালো জিনিস তো কখনো ফ্রি দেওয়া হয় না। তবে কি আমাদের পাঠ্যবই ভালো নয়? খালুকে বোঝাই, এমন মানুষ খুব একটা দেখা যায় না। সবকিছু উনি নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে ভাবেন।
আমাদের এলাকায় বিরোধী দলের একজন নেতা থাকেন। এ খবর শুনে তিনি এমন রাগলেন যে আমি ভাবলাম, উনি এখনই রাজপথে নেমে আন্দোলন শুরু করবেন। তিনি সরকারের এ সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বললেন, সরকার বিনামূল্যে পাঠ্যবই দিলেও তিনি পয়সা দিয়েই কিনবেন। তা তো কিনবেনই। সরকারের সব সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করাই বিরোধী দলের কাজ। তবে আমি ভাবছি অন্য কথা। বিনামূল্যে পাঠ্যবই দিলে বেশ কিছু জাতীয় সমস্যার সৃষ্টি হবে। ঝরে পড়বে অনেক নিবেদিতপ্রাণ চলচ্চিত্রপ্রেমী, যারা বই কেনার টাকা নিয়ে সোজা সিনেমা হলে প্রবেশ করত, সেসব চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের কী হবে? এতে আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প যে কত বড় হুমকির মুখে পড়বে, তা একবারও কেউ ভাবল না। তা ছাড়া এখন তো সবাইকে বই কিনেই পড়তে হয়। ক্লাসে স্যার যখন প্রশ্ন করেন, কী রে, তুই বই আনিসনি কেন, তখন ছাত্র নিশ্চিন্তে উত্তর দেয়, স্যার এখনো বই কেনা হয়নি; কিন্তু বিনামূল্যে বই দিলে তো এ অজুহাত একেবারে মাঠে মারা যাবে। তখন ছাত্ররাই প্রশ্ন করবে, কী ব্যাপার স্যার, আজও বই আনেননি? স্যার হয়তো বলবেন, কী করব বল্? এখনো বই পাইনি।
তবে এ ব্যাপারে পাশের বাসার রহিম সাহেব খুব খুশি। উনি বেশ হাসিমুখেই সেদিন বললেন, সরকার নাকি ফ্রি বই দেবে। ভালোই তো। কেউ পড়ুক আর না পড়ুক, বইগুলো সেরদরে বিক্রি করলেও তো কিছু টাকা লাভ হবে। কী বলেন? আমি মাথা নাড়ি। ব্যবসায়ীদের এই এক সমস্যা। সব জায়গায় লাভ খোঁজে!
আদনান মুকিত
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ১৮, ২০০৯
Leave a Reply