চাল, তেল, মাছ ও মিঠাইয়ের আকাল। আবার ভূতেরও আকাল যাচ্ছে।
বাড়িওয়ালাদের প্রতি অনুকম্পাবশত ভূতেরা শহরের বাস তুলে পাড়াগাঁয়ে আস্তানা জুটিয়েছে, তা-ও নয়। ভূতের উপদ্রব পাড়াগাঁয়েই বা কই? দু-একটা যা শোনেন, অনুসন্ধানে প্রকাশ পেয়েছে, ভূত নয় তারা-ভূতবেশী মানুষ। শহরের অগুনতি হানাবাড়িতে এবং পল্লীর শ্মশানে, গোরস্থানে, বাঁশবাগানে এত যে ভূত থাকত, গেল কোথায় তারা সব? শুনুন বলি। কিন্তু তারও আগে জন্মান্তরবাদটা কিঞ্চিৎ সড়গড় করে নিন।
ধরুন, মরে গেলাম। আপনারা নন, বালাই ষাট।-আমি একলা। মৃত্যুর পর দেহ-খাঁচা থেকে আত্মা ছাড় পেল। যমদূত ধরে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে অমনি যমের দরবারে হাজির করে দেবে। রেজিস্ট্রি খাতায় আত্মা নম্বরভুক্ত হলো, তারপর ছুটি। এ অবস্থার নাম ভূত। পরলোকের কর্তারা অতিশয় বিবেচক-দেহ-খাঁচার অভ্যন্তরে এত দিন কষ্ট করে এলে, ছুটি ভোগ করো এবারে। যদ্দিন না আবার আহ্বান আসছে।
তা-ই করে বেড়ায় ভূতেরা। গাছের চূড়ায় চড়ে প্রাণ ভরে মুক্তবায়ুর নিঃশ্বাস নিচ্ছে খানিক, ঝুপ করে নেমে পড়ে ঢিল-পাটকেল ছুড়ছে এর বাড়ি-তার বাড়ি। এলো চুলে ছুঁড়ি দেখে শেষমেশ তার কাঁধেই বা চেপে পড়ল। তারপর একদিন তলব এসে যায়। পিতামহ ব্রহ্মা ফরমান পাঠিয়েছেনঃ ঘূর্ণিঝড়ে আড়াই লক্ষ মানুষ মারা গেছে, অতএব সমপরিমাণ আত্মা জরুরি আবশ্যক। চিত্রগুপ্ত লিস্টি করে দিলেন, দূতগণ ভূতের আস্তানায় আস্তানায় ছোটাছুটি করছেন, ফুর্তিফার্তি অঢেল হলো, আবার কী। ডিউটিতে ঢুকে পড়ো এবারে।
সেই বন্দী জীবন। দুই, পাঁচ, পনেরো, পঁচিশ, পঞ্চাশ-তেমন তেমন আয়ু্নান হলে নব্বই-পঁচানব্বই বছর অবধি টানবে। মানুষটা না-মরা অবধি ছুটি নেই।
এই নিয়ম চলে আসছে বরাবর। ইদানীং অবস্থা বড় জটিল-ছুটি কমতে কমতে একেবারে শূন্যের কোঠায় ধেয়ে আসছে- এই বেরোল এক দেহ থেকে, সঙ্গে সঙ্গে নতুন দেহে ঢুকে পড়ার পরোয়ানা। নিঃশ্বাস ফেলার ফুসরত দেয় না। আবার ওদিকে মরণ ব্যাপারটা লোপ পেয়ে যাচ্ছে। সার্জারিও এমনি নিখুঁত-একটা আস্ত মানুষ কেটে দুই খণ্ড করে বেমালুম আবার জুড়ে দিচ্ছে। ফলে যমরাজের সেরেস্তায় কাজকর্ম প্রায় বন্ধ। এবং ধরণিতে হু-হু করে জনসংখ্যা বাড়ছে। ফ্যামিলি প্লানিংয়ের বাঁধ দিয়ে ঠেকাবে-নিতান্তই বালির বাঁধ, স্রোতের মুখে দাঁড়াতে পারছে না।
বিষম গণ্ডগোল-যেমন এই ধরালোকে তেমনি পরলোকেও। ছুটি বন্ধ হয়ে বিক্ষুব্ধ ভূতেরা ধর্মঘটের হুমকি দিচ্ছে।
ব্যাকুল হয়ে যমরাজ নিজেই সেকশনে ছুটলেন। ম্যানেজার চিত্রগুপ্ত টেবিলে পা তুলে নাসাধ্বনি করে ঘুমুচ্ছে। ধড়মড় করে উঠে কৈফিয়ত দেয়ঃ মরে না মানুষ-কী করব?
দূতগুলো তোমার কী করে? শুয়ে-বসে আর তাস খেলে ভুঁড়ি যে ওদের পর্বতাকার হলো। ধরাতলে নেমে পড়ুক।
আপসে একটা লোকও মরবে না, বিনি ক্যানভাসিংয়ে আপন নিয়মে কাজ হবার দিনকাল চলে গেছে। দূতেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুঝিয়েসুঝিয়ে দেখুক, আত্মা জোটাতে না পারলে বরখাস্ত করবে। চাকরির দায় বড় দায়। যমদূতেরা দুড়দাড় বেরিয়ে পড়ল। চিত্রগুপ্তও চুপচাপ থাকতে পারে না-চাকরির উদ্বেগে নিজেও বেরোল একসময়।
গিয়ে হাজির কলকাতার এক বাড়িতে। কামারের হাপরের মতো শাঁ শাঁ একটা আওয়াজ আসছে একটানা বাড়ি থেকে। বাড়ির নিচের ঘরে ঢুকে মা-জননী বলে ডাক দিল চিত্রগুপ্ত, হাঁপানির বড় কষ্ট মা-জননী, প্রাণ যে নিগড়ে বের করে।
বেরোয় না, তবু যে আপদ-বালাই মরলে তো বেঁচে যেতাম।
একটা কথা ছুড়েই চিত্রগুপ্ত এতখানি ফল প্রত্যাশা করেনি। পুলকিত চিত্রগুপ্ত আরও তাতিয়ে দিচ্ছেঃ রত্নগর্ভা আপনি মা, আপনার লেখক-ছেলেকে দুনিয়াসুদ্ধ একডাকে চেনে। আপনার মরা তো পাঁচিখেদির মরা নয়-মরে দেখুন, কী মজা তখন।
মা-জননী আর্তনাদ করে ওঠেন, সেটি হচ্ছে না, আগুনে পুড়তে পারব না বাপু। ভীষণ জ্বালা করে। বাঁ পায়ে কেটলির জল পড়ল সেবার, চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করেছিলাম। ঠান্ডা করার মানসে চিত্রগুপ্ত বলে, ধর্মীয় আপত্তি না উঠলে কবরের ব্যবস্থা হতে পারে।
না-বাপু, অন্ধকারে থাকতে পারিনে, ঘরে আমার সারা রাত আলো জ্বলে। মাটির নিচে ঘুরঘুটি, পাতালে থাকা আমার দ্বারা পোষাবে না।
কিছু বিরক্ত হয়ে চিত্রগুপ্ত শুধায়ঃ তবে কি রেখে দিতে বলেন দেহটা?
ওয়াক থু, পোকা পড়বে, গন্ধ হবে-।
ধৈর্য হারিয়ে মা-জননী গর্জে উঠলেনঃ মোলা যা। ঘরে শুয়ে আমি হাঁপ টানি আর জগঝম্প বাজাই-কোথাকার কোন মুখপোড়া এসে মরা-মরা করছে দেখ! বেরো! এভাবে কোথাও সুবিধে করতে পারল না চিত্রগুপ্ত।
রাগে গরগর করতে করতে চিত্রগুপ্ত যমলোকে ফিরল। যমদূতেরাও শয়ে শয়ে ফিরে এল সব দেশ থেকে। একই খবর-আপসে কেউ মরবে না।
যমরাজ আর চিত্রগুপ্ত মুখোমুখি বসে গালে হাত দিয়ে চিন্তা করছেন। আত্মার দুর্ভিক্ষ ঠেকানোর উপায়টা কী?
মাথা খুলে গেল হঠাৎ-চিত্রগুপ্তেরই। বলে, ভেজাল-
একটুখানি ভেবে নিয়ে কণ্ঠে জোর দিয়ে বলে, অব্যর্থ দাওয়াই। রামা শ্যামা ইতরজনদের কাছে যাওয়া ভুল হয়েছে-যেমন আছে থাকুকগে, ওদের ঘাঁটা দিয়ে কাজ নেই। দূতেরা চলে যাক এবার সেরা সেরা লোকের কাছে-যারা ম্যানুফ্যাকচারার, বিজনেস ম্যাগনেট। পাইকার-দোকানদারগুলোকেও চোখ টিপে আসবে। প্ল্যানটা লুফে নেবে ওরা। দুধে নর্মদার জল, চায়ে চামড়ার কুচি, চালে কাঁকর, ওষুধে ময়দা, ময়দায় তেঁতুলবিচি-এসব বহু পরীক্ষিত পুরোনো রেওয়াজ, কোলের বাচ্চাটা-অবধি জানে। চুমরে দিলে মাথা আরও কত শত নতুন মসলা বের করবে, ভেজাল খেয়ে কতকাল মানুষ ‘সুন্দর ভুবন’ আঁকড়ে ধরে থাকে দেখা যাক।
প্রস্তাবটা উল্টেপাল্টে ভালো করে বিবেচনা করে দেখে যমরাজ সায় দিলেনঃ মন্দ বলোনি-কাজ হতে পারে।
পরমোৎসাহে চিত্রগুপ্ত বলে, ভিআইপি রাজপুরুষের কাছেও দূতেরা যাবে। জেনেশুনে তাঁরা যাতে চোখ বুজে থাকেন। ভেজালে তড়িঘড়ি ফলপ্রাপ্তি ঠিকমতো চালু হলে জনসংখ্যা তরতর করে নেমে আসবে।
যমরাজ ভাবছিলেন। তাঁরও মাথায় সহসা আলাদা এক প্ল্যান চাড়া দিয়ে উঠল। বলেন, নরলোকে খাদ্য ভেজাল দিক-আমরাও এদিকে আত্মার ভেজাল চালিয়ে যেতে পারি। মানুষ-আত্মার আকাল তো ভ্রূণের মধ্যে গরু-গাধা, নেড়িকুত্তা, পাতিশিয়ালের আত্মা ঢুকিয়ে যাও। সাপ-ছুঁচো কেন্নো-বিছেতেই বা দোষ কী। বায়ুভূত নিরাকার জিনিস-ভালো রকম মিশাল করে দিয়ো, বুড়ো ব্রহ্মার পিতামহও ধরতে পারবে না।
সেই জিনিস চলছে। নবসমাজে ইদানীং এত যে জন্তু-জানোয়ার কীটপতঙ্গের প্রাদুর্ভাব, গূঢ় রহস্য এইখানে।
(সংক্ষেপিত)
মনোজ বসু : ভুলি নাই, চীন দেখে এলাম, জলজঙ্গল, মানুষ গড়ার কারিগর ইত্যাদি গ্রন্থের লেখক। যশোর জেলার ভাঙ্গাঘাটা গ্রামে ১৯০২ সালে জন্ম।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ১১, ২০০৯
Leave a Reply