মিরাজ হোসেনের দশাসই শরীর। যেমন ওজন, তেমনি সাইজ। তরুণ বয়সে এপাড়া-ওপাড়ার ছেলেদের মধ্যে মারামারির সময় তাঁর এ বপুর বেজায় কদর ছিল। ঘাড়ে লাঠি ফেলে কাছা মেরে দাঁড়িয়ে কুঁদে উঠলে, ওপাড়ার ছেলেরা ঝেড়ে দৌড় লাগাত।
মিরাজের ইচ্ছা ছিল কুস্তিগির হবে। এ জন্য এক আখড়ায় কিছুদিন কুস্তির প্যাঁচ রপ্ত করেছে সে। এতে অবশ্য কোনো লাভ হয়নি। এ দেশে কুস্তিগিরদের ভাত নেই। বিশাল ধড়টাকে কাজে লাগাতে কিছুদিন সে এফডিসিতেও ধরনা দিয়েছে। ছবির নির্মাতারা আফসোস করে বলতেন, ‘পোড়া কপাল তোমার। ফ্যান্টাসি ছবির যুগ নেই। থাকলে দৈত্যের চরিত্র করে দু পয়সা কামাতে পারতে।’
এভাবে অনেক ধান্দা করেও শরীরটাকে জুতসই কোনো কাজে লাগাতে পারেনি মিরাজ। এ জন্য চেনাজানা অনেকে ফাঁক পেলেই টিপ্পনী কাটে, ‘এত বড় শরীরটা কোনো কাজেই লাগাইলা না মিয়া।’
এখন রাজধানীর বেসরকারি এক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে মিরাজ। বেতন মন্দ নয়। কিন্তু দুর্মূল্যের বাজারে টাকা কি আর রাখা যায়? চাল, ডাল, তেল, নুন কিনতে কিনতে ঝরা পাতার মতো উড়তে থাকে টাকা। এর পরও খুব চেপে চুপে, লাঞ্চ আওয়ারে প্রতিদিন পুরি-নিমকি খেয়ে কিছু টাকা জমিয়েছে মিরাজ। সামনে তার পঞ্চম বিবাহবার্ষিকী। বউ তাকে প্রায়ই খোঁটা দেয়, ‘কিছু দেওয়ার মুরাদ নেই, আবার বিয়ে করে বসেছে!’
মিরাজ ঠিক করেছে, বউয়ের মুখে কুলুপ আঁটতে এবার ভালো কিছু উপহার দেবে সে। এ জন্য আজ ব্যাংক থেকে পুরো টাকাই তুলেছে সে। কয়েক বছরে একেবারে খারাপ জমেনি। লকেট ঝোলানো গলার একখান হার তো হবেই।
বিকেলে অফিসের কাজ শেষে ফুরফুরে মেজাজে বের হয় মিরাজ। রাজধানীতে গয়নার মার্কেটের অভাব নেই। মনে মনে একটা বেছে নিয়ে রিকশায় করে সেদিকে রওনা হয় সে। টাকার তোড়াটা প্যান্টের ডান পকেটে রেখেছে মিরাজ হোসেন। নিজের অজান্তেই তার হাত বারবার চলে যাচ্ছে টাকার ওপর। তার এ সন্দেহজনক গতিবিধি নজর কেড়ে নেয় দুই ছিনতাইকারীর। তারা টের পায়, শিকারটাকে আটকাতে পারলে মোটা অঙ্কের টাকা মিলবে। মিরাজের নজর এড়িয়ে তাকে অনুসরণ করতে থাকে তারা। তারপর নির্জন এক চিপাগলিতে মিরাজের রিকশা যেই ঢুকেছে, অমনি দুই ছিনতাইকারী যমদূতের মতো সামনে খাড়া। মাদকসেবী বলে দুটোরই রোগাপটকা চেহারা। দেখলে বোঝা যায়, গায়ে তেমন জোর নেই। তাই বলে তেজ কম নয় তাদের। রিকশাওয়ালাকে অকারণে গোটা কয়েক চড়চাপড় দিল একজন। অপরজন মিরাজের দিকে পিস্তল বাগিয়ে গর্জে উঠল, ‘পকেটে যা আছে জলদি বাইর কর, নইলে ভুঁড়ি ফুটা কইরা দিমু।’
আগ্নেয়াস্ত্রের ক্ষমতা অসীম। মিরাজের হাত চট করে পকেটে গিয়ে টাকার তোড়া বের করে আনল। কিন্তু তোড়াটা দিতে গিয়ে মিরাজের মনে হলো, তার কলজেটা যেন ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে। চিঁ চিঁ করে সে কাতর কণ্ঠে বলল, ‘টাকা নেন আফসোস নেই, তবে একটা উপকার করে যান ভাই।’
গা থেকে মিরাজ চট করে কোটটা খুলে বলল, ‘পায়ে পড়ি ভাই, এই কোটের পিঠে একটা গুলি করে যান।’
‘কেন, কেন?’ অবাক দুই ছিনতাইকারী।
‘বউয়ের কাছে গিয়ে অন্তত বলতে পারব, আপসে টাকা দিইনি। লড়াই করে দিয়েছি।’
পিস্তলধারী ছিনতাইকারী সানন্দে কোটের পিঠ ফুটো করে দিল। অমনি মাতম করে উঠল মিরাজ, ‘হায় হায় ভাই, এটা কী করলেন! কোটের ঠিক মাঝখানে যে ফুটো করলেন, এতে তো আমার বুক ফুটো হওয়ার কথা। আমার বউ এত বোকা নয়, সে ঠিকই বুঝবে আমি চালাকি করেছি। দয়া করে কোটের এমন জায়গায় ফুটো করুন, যাতে শরীরে গুলি লাগার কোনো সুযোগই থাকবে না।’
ছিনতাইকারীরা এবার কোটের এক হাতা ফুটো করে দিল। অমনি হা-হা করে উঠল মিরাজ, ‘আরে ভাই, আবার তো ভুল হয়ে গেল। এ গুলি তো হাতে লাগার কথা।’
পিস্তলধারী ছিনতাইকারী এবার বেজায় চটে গেল। আক্রোশ ঝেড়ে সে বলল, ‘এত ঝামেলার চেয়ে তোর ভুঁড়ি ফুটা করাই তো ভালো ছিল রে! তোর সৌভাগ্য যে পিস্তলে আর গুলি নাই।’
এবার মিরাজ হোসেনকে আর পায় কে। এক লাফে রিকশা থেকে নেমে দুই হাতে দুই ছিনতাইকারীকে পাকড়াও করল সে। হুংকার ছেড়ে বলল, ‘এবার দেখ বেটারা, কুস্তির প্যাঁচ কাকে বলে!’ তার বিশাল দুই বাহুর ভেতর পটকা ছিনতাইকারীরা তড়পাতে লাগল ফাঁদে পড়া নেংটি ইঁদুরের মতো।
[বিদেশী গল্পের ছায়া অবলম্বনে]
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ১১, ২০০৯
Leave a Reply