বিদেশে কী দেখে এলেন স্যার? কত কি! না দেখলে তোমার বিশ্বাসই হবে না। যে স্বদেশ কোনো দিন বিদেশ হবে। এই চওড়া চওড়া রাস্তা। মসৃণ, তকতকে, ঝকঝকে। তার ওপর দিয়ে আশি, নব্বই, এক শ কিলোমিটার বেগে রংবেরঙের গাড়ি ছুটছে। রাস্তা এত মসৃণ যে তুমি গাড়ির আসনে বসে, স্বদেশে ফেলে রেখে যাওয়া টেপী কিংবা বুঁচিকে প্রেম-পত্তর লিখতে পারো। গাড়ি লাফাবে না, ঝাঁপাবে না, ডাইনে বামে কাত মারবে না। যেন আঠার মতো রাস্তার সঙ্গে লেগে আছে।
গর্ত নেই স্যার? ছোট, বড়· মাঝারি মাপের গাড্ডাসমূহ?
না, গাড্ডাসমূহ নেই।
কেন নেই স্যার?
যাও, গিয়ে জিজ্ঞেস করে এসো কেন নেই! ও বিষয়ে কোনো সিটি মেয়রের সঙ্গে আমার আলোচনা হয়নি।
সুন্দরী রমণীর গালে টোল নেই, মাইলের পর মাইল রাস্তার গর্ত নেই, এ তো পরিকল্পনার এক ধরনের ত্রুটি। মানুষ কত বিশ্রীভাবে সৎ হলে তবেই না অমন কাণ্ড হয়! জঞ্জাল আছে স্যার? দু হাত অন্তর অন্তর আবর্জনার স্তূপ?
পাগল হয়েছ? রাস্তার ধারে আবর্জনা এ কি তোমার স্বদেশ, এর নাম বিদেশ!
কী দুঃখের দেশ স্যার! মানুষ ভালোভাবে খেতে পায় না। পেলে রাস্তার ধারে, মাঠেঘাটে সর্বত্র জঞ্জাল পড়ে থাকত।
তোমার মুণ্ডু। ও দেশের মানুষ দিনে-রাতে চার থেকে পাঁচবার খায়। ঘুরছে-ফিরছে কুপ কুপ খাচ্ছে। ফ্রুট জুস, হট ডগস, হ্যামবার্গার, চিকেন লেগস, প্যাটিস, প্যাসট্রিজ, ব্রেড, বাটার, ওমলেটস, রোলস। সে খাওয়া যে কী খাওয়া, তুমি ইমাজিন করতে পারবে না।
হৃদয়হীনের দেশ স্যার। এত বড় স্বার্থপর, অন্যের কথা ভেবে আঁস্তাকুড় তৈরি করে না, আর পাঁচজন কী খাবে একবারও ভাবে না।
তার মানে?
স্যার, যারা আবর্জনা খুঁটে খাবার সংগ্রহ করে তাদের কী হবে! এর নাম খ্রিষ্টান!
তুমি একটি অজমূর্খ। ও দেশে কাউকে জঞ্জাল খুঁটে খাবার বের করতে হয় না। সবাই মোটামুটি বড়লোক।
কী বিশ্রী দেশ স্যার! যে দেশে অভাব নেই, সে দেশের আর রইল কী! সবাই এক বউ নিয়ে ঘর করছে।
তার মানে?
মানুষের তো দুই বউ স্যার! স্বভাব আর অভাব। ওদের অভাব নেই, স্বভাবটাই কেবল আছে। অমন দেশে যান কেন? রেশনের দোকান আছে? রেপসিড তেল ঠিকমতো পাওয়া যায়?
তোমার অসীম অজ্ঞতায় আমার রাগে শরীর জ্বলছে।
রেশনে কি চাল দেয় স্যার? ভাঙা আতপ, না বোগড়া সেদ্ধ!
গর্দভ! ও দেশে রেশন নেই।
সে কী, পুরোটাই কালো বাজার! একটাই মাত্র মার্কেট! হোয়াইটের দেশে ব্ল্যাক মার্কেট! ভবিষ্যতে ও দেশে আর যাবেন না, চরিত্র বিগড়ে যাবে।
এ অর্বাচীনের সঙ্গে কথা বলে কী হবে। নেহাত ওই বিপ্লবের দিনে শিখেছিলুম দেশের কুকুর ধরি বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া। তা না হলে তোমাকে আমি ঘাড় ধরে দূর করে দিতুম।
রাগ করছেন কেন স্যার? আমরা তো কোনো দিন বিদেশে যেতে পারব না, তাই তো জানার বাসনা। ওখানে সকালে দুধের ডিপোর সামনে লাঠালাঠি হয় স্যার! ট্যাঁ ফোঁ, ভোঁ।
না, ও দেশের মানুষের অত সময় নেই। সাতসকালে উঠেই তেলাপিয়া মাছের মতো বাজারে, ডিপোর সামনে ইজিরবিজির করবে, সে দেশ এ দেশ নয়। দরজায় দরজায় ভোরবেলা দুধের বোতল, সংবাদপত্র, ফুল এই সব রেখে যায়। ঘুম থেকে উঠে ও দেশের বউমারা টুক করে দরজা খোলে, পুটপুট করে সব ভেতরে টেনে নেয়।
কে রেখে যায় স্যার। বউমার পূর্বপ্রেমিক?
প্রেমিক আসছে কোথা থেকে গবেট! অপ উপন্যাস পড়ে পড়ে মগজ ধোলাই হয়ে গেছে!
ওই যে ফুলের কথা বললেন স্যার। ফুল, বোতল আর সংবাদপত্র।
ওহে ইডিয়েট! ওরা ওমর খৈয়ামের নীতিতে বিশ্বাসী। রোজগারের সবটাই ওরা পেটায় নমঃ করে না। ফুলের জন্য কিছু রাখে। ফুল আর ফল, যেমন আমাদের কান আর মাথা।
ফল? কোন ফলের কথা বলছেন স্যার, কর্মফল?
আজ্ঞে না, গীতার ফল নয়, গাছের ফল। কমলালেবু, আপেল, কলা, আঙ্গুর, আখরোট, খেজুর, কাজু। খাবার-টেবিলে থরে থরে সাজানো। ফুলদানিতে ফুল। ছবিটবি দ্যাখোনি কোনো দিন! ওল্ড মাস্টারসদের আঁকা স্টিল লাইফ জীবনে দ্যাখোনি?
ছি ছি কী দুর্নীতিপরায়ণ ওরা!
কেন?
ঘুষের পয়সা ছাড়া এসব হচ্ছে কী করে? এ দেশে দু বেলা দু মুঠো জোটাতেই আমাদের আধ হাত জিভ বেরিয়ে যাচ্ছে। ওদিকে ফুল, ফল! শখের প্রাণ গড়ের মাঠ।
আরে না রে বাবা, ওদের রোজগারও তেমনি।
তার মানে ওয়াগন ভাঙে, ্নাগল করে, ব্যাংক ডাকাতি করে।
তোমার মাথা। ওখানে বড় বড় কল, কারখানা, চাষবাস, ব্যবসা-বাণিজ্য। টাকার বন্যা বইছে।
স্যার ধর্মঘট নেই? মিছিল নেই? রোজ বিকেলে, চলবে না, চলবে না।
না, ওসব চোখে পড়েনি।
বাজে জায়গা।
ঠিক বলেছ, থার্ড ক্লাস জায়গা। যেখানে-সেখানে, যত্রতত্র, যা-তা করা যায় না। ব্যক্তিস্বাধীনতার অভাব। এখানে দ্যাখো, দেয়াল দেখলেই তুমিও পা তুলছ, কুকুরও পা তুলছে।
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সাহিত্যিক [জন্ম-১৯৩৪]
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ০৪, ২০০৯
Leave a Reply