আমার স্ত্রী একদিন বললেন, দেখো, আমাদের বাড়িতে একটা কুকুর পুষলে বেশ ভালো হয়। আমাদের একঘেয়ে জীবনটা বিশ্রী।
কথাটা শুনে মনে একটু আঘাত পেলাম। আমার সঙ্গটা তাহলে তাঁর কাছে একঘেয়ে লাগছে! এ ছাড়া ভাবলাম, মানুষের জীবনে কুকুর প্রায় বন্ধুর মতোই। খুব উপকারী বন্ধু।
কাজেই স্ত্রীর কথায় রাজি হলাম।
তারপর একদিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখলাম, আমার বিছানার ওপর একরাশ কালো উল পড়ে আছে। খানিকটা উল লম্বা হয়ে বেরিয়ে আছে লেজের মতো। আমি ঘরে গিয়ে দাঁড়াতেই উলের রাশ থেকে গরর-গরর গর্জন শোনা গেল। আমি তার দিকে চোখ পাকিয়ে রইলাম। সেও। অর্থাৎ প্রথম দর্শনে দুজন দুজনকে পছন্দ করলাম না।
স্ত্রী গদগদ হয়ে বলল, জানো, এ হচ্ছে ডলি। মেয়ে তো, তাই নাম ডলি।
ডলি তার উলের ভেতর থেকে খুব ভক্তিভরে আমার স্ত্রীর দিকে চাইল। ডলির চোখের ভাব দেখে মনে হলো, সে তার মালিককে জিজ্ঞেস করছে-এই অদ্ভুত লোকটা কে? এখানে কেন? দেব নাকি কামড়ে?
আমি স্ত্রীর মন রেখে বললাম, বাহ্, বেশ তো কুকুরটা! তা এ সপ্তাহটা কাটবে ভালো আমাদের।
-তার মানে? এক সপ্তাহ বলছ কেন?
-মানে, কুকুর এক জায়গায় বেশি দিন থাকে না, জায়গা বদল করতে চায়। নিকোলাইকে দিয়ে দিলেই হবে।
-সে কি কথা! কী যা-তা বলছ! ডলি আমাদের কাছেই থাকবে।
কুকুররা বোধহয় মানুষের কথা বুঝতে পারে। ডলিও পারল বোধহয়। সঙ্গে সঙ্গে সে আমার স্ত্রীর হাতখানা চাটতে লাগল, আর আমার দিকে এমন কটমট করে চাইল যে লজ্জায় আমি এতটুকু হয়ে গেলাম।
আমি মনে মনে কুকুরটাকে বয়কট করলাম। ঠিক করলাম ওটাকে একদম পাত্তা দেব না। আর সুযোগ-সুবিধা পেলেই পশ্চাদ্দেশে লাথি কষাব। ওকে বুঝিয়ে দেব, ও এ বাড়িতে একটা সামান্য কুকুর ছাড়া আর কিছুই নয়। ওকে মাথা তুলতে দেওয়া ঠিক হবে না। সে কি আমার মনের কথাও বুঝতে পারল? সে তার দুপাটি ধারালো দাঁত বার করে আমার দিকে চেয়ে আবার শব্দ করল, গরর···গরর। একদিন সকালে উঠে দেখি আমার খাটের নিচে চটিজোড়া নেই। আমি সারা ফ্ল্যাট খুঁজে বেড়াতে লাগলাম আর ডলি সর্বক্ষণ আমার পেছন পেছন ঘুরতে লাগল। মুখে-চোখে তার কী আনন্দ! আমি বেশ বুঝতে পারলাম, এই অপকম্ম ডলিরই। কিন্তু হায়, কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই। সেই চটিজোড়া আমার স্ত্রী পরে বার করলেন ঘরের ময়লা ফেলার ঝুড়ির ভেতর থেকে। আমি এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে ছড়িটা বার করে ডলিকে দেখিয়ে শাসিয়ে বললাম, ফের এ রকম করলে ছড়িটা তোর পিঠে ভাঙব।
ডলি মনে হলো আমার কথাটা বেশ মন দিয়েই শুনল। এমনকি মনে হলো সে মাথা নেড়ে জানাল সে বুঝেছে কথাটা। আর সেই দিনই সন্ধ্যাবেলায় আমার ছড়িটা খুঁজে পাওয়া গেল না। আহা, ওটা আমার শখের ছড়ি। আমার এক বন্ধুর উপহার। এখন তো শীতকাল, বাইরে বরফ পড়ছে। ডলির তো বাইরে যাওয়ার কথা নয়। সে কি হজম করে ফেলল ছড়িটা, না কি বাইরে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়ে এল?
ক্রমেই ডলির সঙ্গে আমার সম্পর্কটা তেতো হয়ে উঠল। কিন্তু বদমায়েশি মতলব আঁটার অনেক সময় তার। অথচ আমার অত সময় নেই।
আর এমন বদমায়েশ এই ডলি যে কী বলব, আমার স্ত্রীর বন্ধুরা যখন বাড়িতে আসেন তখন তাঁদের সঙ্গে কী ভদ্র ব্যবহার! যেন একটি লেডি। তাঁরা গায়ে হাত বোলালে ও কিচ্ছু বলে না। আর আমার বন্ধুরা যখন আসে, তখন তার ভদ্রতাটদ্রতা সব চুলোয় যায়। ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গিয়ে দাঁত বার করে নাক কুঁচকে চোখ পাকিয়ে ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করে। পারে তো জামাটামা টেনে ছিঁড়ে দেয়।
একবার আমার এক পুরোনো বন্ধু এসেছিল আমার বাড়িতে। তাকে বসিয়ে রেখে আমি গেলাম দোকানে কিছু খাবার কিনে আনার জন্য। ফিরে এসে দেখি, আমার সে বন্ধু ভয়ে লাফাচ্ছে আর ডলি ঘেউ ঘেউ করে ভয় দেখাচ্ছে। আর বেচারার প্যান্টের নিচের দিকটা ডলি তার দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে শতচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। আমাকে দেখে ডলি তাকে ছেড়ে দিয়ে তার শিকারের প্রতি একটা ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বিজয়গর্বে চলে গেল বাড়ির ভেতর।
ডলি আমার স্ত্রীর ভালোবাসা আদায় করেছে। শুধু এ জন্যই বাধ্য হয়ে তার বেয়াদবি ক্ষমা করতে হলো। এমনকি কষ্ট করে জোগাড় করা একটা ফুটবল ম্যাচের টিকিট পর্যন্ত ডলি গলাধঃকরণ করেছে জেনেও নিজেকে বহু কষ্টে সংযত রাখলাম। একদিন বারান্দায় বালিশের ওয়াড়গুলো যখন শুকোচ্ছিল, তখন ওই ডলি সবগুলো ক্লিপ থেকে টেনে খুলে নিয়ে বাইরে উড়িয়ে দিল। মনে হলো, সাদা পাখিরা হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি নিচে ছুটে নেমে গিয়ে সেগুলো এদিক-ওদিক থেকে কুড়িয়ে আনলাম। তা দেখে পাড়ার ছোড়াগুলোর কী তখন সিটি মারা! যেন মঞ্চে তাদের প্রিয় নায়ককে দেখতে পেয়েছে।
এবার আমি ধৈর্য হারালাম। স্ত্রীকে বললাম, আর পারা যায় না। এখন উচিত হচ্ছে ওই ডলিকে জানালা গলিয়ে রাস্তায় ফেলে দেওয়া। আমার এই প্রস্তাবে স্ত্রী গালে হাত দিয়ে চোখ বড় বড় করে জানালেন, আমার মতো নিষ্ঠুর নাকি এই পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। অতএব, ঠিক হলো ডলিকে একটা ট্যাক্সিতে চাপিয়ে অন্তত ১০ কিলোমিটার দূরে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে···।
তা-ই হলো। বেশ বড় এক টুকরো হ্যাম অতি যত্নে ডলিকে খাওয়ানো হলো। পরে তাকে ট্যাক্সিতে তোলা হলো। ১০ কিলোমিটার দূরে একটা খোলা নির্জন জায়গায় তাকে ট্যাক্সি থেকে নামানো হলো এবং আমি আমার মনের আনন্দে ডলির পশ্চাদ্দেশে সজোরে মারলাম একটা লাথি। ডলি ছিটকে গিয়ে কেঁউ কেঁউ করতে লাগল। আমি ট্যাক্সিভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিলাম। কিন্তু আশ্চর্য, বাড়ি ফিরে দেখি ডলি আমার চেয়েও আগে এসে পৌঁছে গেছে বাড়িতে। আমাকে দেখেই সে তার ধুলোভর্তি গা-টা এমন জোরে ঝাড়ল যে আমার পোশাক, চোখ-মুখ সব ধুলোয় মাখামাখি হয়ে গেল। ডলি আমার দিকে লোমের ফাঁক দিয়ে কুতকুত করে চেয়ে দেখে নিল একবার। ভাবখানাঃ কেমন মজা! তারপর লেজ নাড়তে নাড়তে ঢুকে গেল ফ্ল্যাটের ভেতর।
অগত্যা আমাদের একসঙ্গে আবার ঘর করতে হলো। মনে মনে বুঝলাম, এই ডলির হাত থেকে আমার পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো উপায় নেই। কাজেই আমি কেবলই ভাবার চেষ্টা করতে লাগলাম, কুকুরই হচ্ছে মানুষের একমাত্র বিশ্বাসী বন্ধু।
কী, এই রকম একটি বিশ্বাসী বন্ধু চাই নাকি? তাহলে কিছুদিন ধৈর্য ধরো। ডলির বাচ্চা হলে তোমাকে একটা দেব। কথা দিচ্ছি।
ডি সানিন, রাশিয়ান রম্য লেখক।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ২৭, ২০০৯
Leave a Reply