আদম আলী আমার দাদু। বেশ আগে একবার শহরে বেড়াতে গিয়েছিল দাদু। দাদু দেখল, কী একটা বস্তুতে যেন অনেকেরই চোখ ঢাকা। দেখতে স্বচ্ছ অথবা কালো গ্লাস বাঁকা দুটি আংটা দিয়ে কানের সঙ্গে জড়ানো। শহরে এটাকে বলে ‘চশমা’। কারও চোখে বা কপালে ওটা দেখলেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকত দাদু।
বাড়ি আসার সময় পথের পাশে এক চশমার দোকানে ঢুকে এপাশ-ওপাশ দেখেও একটা জুতসই চশমা বের করতে পারল না দাদু। দোকানিকে জিজ্ঞেস করল, ভালো চশমা হবে?
-কম পাওয়ারের নিবেন, না বেশি পাওয়ারের?
-দাম কোনটার কত, শুনি?
-দাম সব একই।
-তাহলে বেশি পাওয়ারই দিন, কমটা নিয়ে লাভ কী?
চশমা নিয়ে ফুরফুরে মনে গাঁয়ে চলে এল দাদু।
একদিন চশমাটা চোখে দিয়ে মাছবিক্রেতাকে দাদু হাঁকাল, এই ইলিশ মাছটার দাম কত রে?
মাছওয়ালা তো থ! বড় বড় চোখে ডালার দিকে তাকাল। ডালার এক পাশে একটা ছোট পুঁটি মাছ ঝিলঝিল করছে রোদে। অট্টহাসি দিয়ে মাছওয়ালা বলল, দাদা, ২০০ টাকা দিন।
-অত চাইলে বিকিবি কী করে শুনি? বড্ড বেশি হলো রে!
-দিন না টাকা পঞ্চাশ কম!
-হয়েছে! ঢোকা আমার ব্যাগে।
দাদু ১০০ টাকার একটা কচকচে নোট দিয়ে বাড়ি এসে দাদিকে বলল, বড় একটা ইলিশ আছে ব্যাগে।
দাদি দা-বঁটি নিয়ে কাটতে গিয়েই বাধল ঝামেলা। সারা ব্যাগ খুঁজে কোথাও দাদুর বর্ণিত ইলিশের কোনো অস্তিত্বই পাওয়া গেল না। হুঙ্কার ছুটল দাদুর পানে।
-কই তোমার ইলিশ মাছ, আমার কালাচান!
-চক্ষে তো একেবারেই দেখ না। দেখি? এই, এই যে ইলিশ-বলে ব্যাগের এক কোনা থেকে বের করলেন।
জামার কলারে দাদির হাতের টান লাগতেই দাদুর চশমা ছিটকে পড়ল মাটিতে। খালি চোখে মাছটা দেখেই দাদুর চোখ দুটি ছানাবড়া! অতটুকুন চুনোপুঁটি কিনেছে ১০০ টাকা দিয়ে!
মনের খেদে পরদিনই গেল শহরে। চশমাটা দোকানে ফেরত দিয়েই হাঁটা দিল। একটু হাঁটতেই এক বৃদ্ধ রমণী কপালে চশমা ঠেকিয়ে মুখটা বাঁকিয়ে চলে গেল।
অসম্ভব! চশমা আমার লাগবেই। দাদু ফিরে এল দোকানে। দোকানিকে বুঝিয়ে একটা কম পাওয়ারের চশমা নিল এবার। এখন আর ঝামেলা নেই-এই ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল দাদু।
একদিন নাতনির বাড়িতে নিমন্ত্রণ পড়ল। দাদু চলল সবার আগে। সামনে পড়ল নদী। চশমাটা তখনো চোখেই ছিল। এক পা এগিয়ে দুই পা পিছিয়ে ডানে-বাঁয়ে সরে গিয়ে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করল দাদু।
-একটা ছোট নালা। ওপারে যেতে পাঁচ কদমই যথেষ্ট। অথচ বোকা মানুষগুলো খালি খালি নৌকা ডাকে।···
দাদু হাত দশেক পেছনে সরে পাঞ্জাবিটা গোছাল। জুতো দুটো নিল দুই হাতে। মারল দৌড়। হেইয়া বলে দিল লাফ! পড়ল গভীর জলে। চশমাটা চোখেই। মাথা উঁচিয়ে দেখে কয়েক হাত দূরেই কিনারা! ডুবে ডুবে, সাঁতরে সাঁতরে সামনে এগোল দাদু। আবার তাকিয়ে দেখল, তীর খুবই কাছে! অতঃপর হাত-পা চালাল দ্রুত। আবার হুপ করে মাথা উঁচিয়ে দেখল, সামনেই তীর। আবার চলল, কিন্তু কূল পাচ্ছে না কেন! হঠাৎ পেছনে টান পড়ল। কে যেন দাদুকে টেনে ওঠাচ্ছে একটা ছোট্ট নৌকায়।
দাদু বলল, এ নৌকায় আমার ভার সইবে না। শিগগিরই তলিয়ে যাবে। উঠাস নে, তোরা ডুবে যাবি! ছেড়ে দে আমাকে···।
দাদুকে তীরে তোলা হলো। হাত-পা কাঁপছে থরথর। পেটটা ফুলেছে ডুবে ডুবে জল খেয়ে। চশমাটা কপালে ঠেকিয়ে কৃতকর্মের সমীকরণ কষছে দাদু!
দাদি এসে গলা ফুলিয়ে বলে উঠল, ওরে বুড়ো! সাঁঝের বেলায় ফুলবাবু হয়ে সাঁতরাবার শখ হয়েছে?
-ইচ্ছে তো মাঝেমধ্যে হয়।
গম্ভীর গলায় দাদু চশমাটা দেখিয়ে বলল, এ-ই আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। ভালোই বলতে পার।
দাদি ছোঁ মেরে চশমাটা নিল। দাদুর বাধা সত্ত্বেও এক ঢিলে নদীর মাঝখানে ফেলতে ফেলতে বলল, বুড়োকে ডুবিয়েছ জলে, এবার তুমি যাও তলে।
— সংগ্রহেঃ জহির গাজী, সূর্যসেন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ২০, ২০০৯
Leave a Reply