আমার নাম উসাচেভ-ভালেন্তিন গ্রেগরিয়েভিচ উসাচেভ। আমি একজন চিত্রশিল্পী। আমার আঁকা ছবি প্রায় সব প্রদর্শনীতেই দেখানো হয়। আমাকে সবাই সৎ আর সম্মানীয় ব্যক্তি বলেই জানে। অনেক দিন ধরেই আমার নিজের ধারণাও তা-ই ছিল। কিন্তু সম্প্রতি আমার মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
ব্যাপারটা হচ্ছে, এখনো আমাদের মধ্যে এমন লোকও আছে, যাদের ব্যবহারে আমাকে বাধ্য হয়ে সৎ পথ আর শান্তির পথ ছেড়ে অন্য পথে যেতে হয়।
গত বছরই ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল। আমার মেয়ে আনার অসুখ হলো। ডজনখানেক ডাক্তার দেখানো হলো, কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।
শেষে একজন পরামর্শ দিল কর্ণরোগ-বিশারদ ডাক্তার দেখাতে। তিনি আমার অজানাও নন। কানের রোগ ধরতে তিনি ওস্তাদ।
আমি কর্ণরোগ-বিশারদকে ফোন করলাম। মনে হলো, বিখ্যাত যাঁরা, তাঁরা নিজেরা ফোন ধরে উত্তর দেন না। এক মিহি গলার মহিলা জানালেন, তিনি তো এখন খুবই ব্যস্ত। শিগগিরই যে আপনার কেসটা দেখতে পারবেন, তা বলেও মনে হয় না। ঠিক সেই সময় আমার বন্ধু ভূতত্ত্ববিদ ইভান নিকোলায়েভিচ এসে উপস্থিত। আমি তাকে ব্যাপারটা বললাম। দুজন বসে পরামর্শ করলাম, আনার কানের অসুখের বিষয়ে কী করা যায়।
হঠাৎ ভূতত্ত্ববিদ লাফিয়ে উঠল, হয়েছে, হয়েছে। ওই ডাক্তারের ফোন নম্বরটা দে তো। আমি তাঁকে ফোন করব। মনে হয়, তিনি আর আপত্তি করবেন না।
-ওঁকে চিনিস নাকি?
আমি বন্ধুকে ফোন নম্বরটা দিলাম, যদিও জানি, সে কিছুই করতে পারবে না।
ভূতত্ত্ববিদ ফোনে বলতে লাগল, এটা কি প্রফেসর এনের বাড়ি? আমি চিত্রশিল্পী উসাচেভের প্রাইভেট সেক্রেটারি ফোন করছি। উনি খুবই চিন্তিত হয়েছেন···ডক্টর··· ইত্যাদি ইত্যাদি।
পরে রিসিভারটা নামিয়ে রেখে ভূতত্ত্ববিদ জানাল, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই কর্ণরোগ-বিশারদ আসছেন।
-তার মানে?
-মানে সোজা। তোর মেয়ের কান দেখতে আসছেন।
-তা তো বুঝলাম। কিন্তু কেন? কী করে?
-অত জেরা কোরো না বাপু।
তবে বলল, ব্যাপারটা খুবই সহজ-সরল। এখনো এমন অনেক লোক আছে, সোজাসুজি কোনো কিছু পছন্দ করে না। ভড়ং চায়। উপাধিহীন লোকের গান-বাজনা ছবি বা লেখা সবকিছুই ওদের কাছে বাজে, বাতিল। আবার উপাধির চেয়েও বড় হচ্ছে প্রাইভেট সেক্রেটারি। প্রাইভেট সেক্রেটারি যার নেই, সে কিসসু নয়। আর যার আছে, সে-ই ভিআইপি।
এই ঘটনার কিছুদিন পর আমার ঘরটা পরিষ্কার করার দরকার হলো। আমি মস্কোর সব জায়গায় ঘুরে হয়রান হয়ে গেলাম। কেউ আসতে রাজি হলো না। শেষে মতলব খাটালাম। টেলিফোন ডাইরেক্টরি থেকে এক নামকরা ক্লিনিং সংস্থাকে ফোন করলাম, যদিও আমি নিজে গিয়েও তাদের আসতে রাজি করাতে পারিনি।
-হ্যালো, আমি চিত্রশিল্পী উসাচেভের প্রাইভেট সেক্রেটারি ফোন করছি। তিনি জানতে চাইছেন···
আমাকে তাঁরা থামিয়ে দিলেন। ‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, তাঁর নির্দেশমতো সবকিছুই হবে। আমাদের কাজে তিনি খুশিই হবেন আশা করি।’
এরপর আমার কোট-প্যান্ট ড্রাই ক্লিনারের কাছে কাচাতে নিয়ে গিয়ে নিজেকে উসাচেভের প্রাইভেট সেক্রেটারি বলেই পরিচয় দিয়েছি। তাতে খাতির পেয়েছি। এভাবে করতে করতে শেষ পর্যন্ত এমন হলো, নিজের কাছে নিজেকেই ছোট মনে হতে লাগল, আমার সেক্রেটারি আমার কাছে বড় হলো। আমিই নিজেকে বলতে লাগলাম, উসাচেভ, তোমার প্রাইভেট সেক্রেটারির কাছে তুমি একটা অকর্মার ঢেঁকি। ক্রমে আমি ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির কাছে খাতির পেতে লাগলাম। অনায়াসে অপেরার টিকিট পেতে লাগলাম। গৃহ-সংস্থাকে দিয়ে আমার ঘর সাজিয়ে নিতে পারলাম। নিয়মিত খবরের কাগজ পাওয়া গেল-আর সবই আমার ওই অস্তিত্ব না থাকা প্রাইভেট সেক্রেটারির কৃপায়।
আমার সেক্রেটারি কখনো বেআইনি কিছু করেনি। তবে আইনত কোনো কিছু না পেলে তখনই আমি প্রাইভেট সেক্রেটারির সাহায্য নিতাম।
অবশ্য মাঝেমধ্যে তাকেও হার মানতে হতো। শুনতে হতো, কমরেড উসাচেভকে জানাবেন, এ কাজটা করা গেল না বলে দু:খিত।
তবে বেশির ভাগ কাজই যে কীভাবে হাসিল করত, তা আমি নিজেই বুঝে উঠতে পারতাম না।
যাক, তোমাদের সময় আর বেশি নষ্ট করব না। আমাকে আবার বাড়ি যেতে হবে। আমি থাকি তো শহরের বাইরে। একটা ট্যাক্সি ডাকা দরকার। যদি ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে ফোন করে বলি, একটা ট্যাক্সি পাঠিয়ে দাও তো এই ঠিকানায়, সঙ্গে সঙ্গে উত্তর আসবে, স্ট্যান্ডে কোনো ট্যাক্সি নেই। শিগগির পাওয়াও যাবে না।
অগত্যা আমাকে রিসিভার নামিয়ে তখনই আবার ফোন করতে হবে ওই ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে: শিল্পী উসাচেভের প্রাইভেট সেক্রেটারি কথা বলছি। এই ঠিকানায় একটা ট্যাক্সি এক্ষুনি দরকার তাঁর। ···কী, মিনিট পনেরোর মধ্যে আসবে? ঠিক আছে।
কাজেই এখন বুঝতে পারছ, আমার সেক্রেটারি কী দরের লোক। একেবারে শয়তানের যাসু।
গ্রিগরি রিকলিন
অনুবাদ: কুমারেশ ঘোষ
গ্রিগরি রিকলিন: রাশিয়ান রম্য লেখক।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ১৩, ২০০৯
Leave a Reply