আব্দুল করিম সাহেবের বাসার সামনের গাছতলায় আড্ডা হচ্ছে। ঠিক আড্ডা বলা যাবে না, জটিল গবেষণা হচ্ছে বলা যায়। কারণ আব্দুল করিম সাহেব নিখোঁজ। পয়লা বৈশাখ থেকেই তিনি নিখোঁজ। তাঁকে নাকি পয়লা বৈশাখের কালবোশেখি ঝড় উড়িয়ে নিয়ে গেছে।
– তুমি ঠিক দেখেছ উনাকে কালবোশেখি ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে গেছে?
– অবশ্যই। আমরা দুজন একসঙ্গে বাজার করলাম···
– তারপর?
– তারপর তিনি একটা ইলিশ কিনলেন, আমি কিনলাম বোয়াল···বউ বলেছিল বোয়ালের সঙ্গে লাউ কিনতে···
– উফ! শটকাটে বলো।
– তিনি ইলিশ কিনে বের হলেন···
– আচ্ছা তিনি হঠাৎ করে ইলিশ কিনলেন কেন? আরেকজন জানতে চায়।
– বাহ্, পয়লা বৈশাখ···পান্তা-ইলিশের একটা ব্যাপার আছে না?
– কিন্তু তিনি তো একা মানুষ।
– একা হলে কী হয়েছে, শখ-আহ্লাদ থাকতে পারে না?
– আহ্, আপনারা মূল প্রসঙ্গে আসুন। তারপর কী হলো?
– তারপর শুরু হলো কালবোশেখি ঝড়···তিনি দৌড়ে ঠিক এই গাছতলায় ছুটে এসে দাঁড়ালেন। আর আমি মোক্তারদের বাসার গেটে আশ্রয় নিলাম···তখনই ৮০ মাইল স্পিডে একটা দমকা হাওয়া···হঠাৎ দেখি উনি নাই···
– ৮০ মাইল স্পিড তুমি কী করে বুঝলে?
– আরে বোঝা যায়। ঝড় তো আর কম দেখলাম না।
– কিন্তু খুব শিগগির কি আশপাশে মাংস-বৃষ্টি হয়েছে?
এলাকার ব্রেনওয়াশ কোচিং সেন্টারের পরিচালক মোতাব্বের জানতে চান।
– মাংস-বৃষ্টি?
– হ্যাঁ।
– কেন, মাংস-বৃষ্টি হবে কেন?
– হয় হয়। এগুলো বিজ্ঞানের কথা, আপনারা বুঝবেন না। ঝড় যদি মানুষ, গরু, ছাগল উড়িয়ে নিয়ে যায় আকাশে, তাহলে দুই দিন পর মাংস-বৃষ্টি হয়। কেন, মনে নেই, একবার খবরের কাগজে বের হলো ‘কুমিল্লায় মাংস-বৃষ্টি’।
বিষয়টা ব্রেনওয়াশ কোচিং সেন্টারের পরিচালক ব্যাখ্যা করলেন সবার কাছে-ঝড় যখন কাউকে উড়িয়ে নিয়ে যায় তখন ঝড়ের দমকা বাতাসের ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে মানুষটা (বা প্রাণীটাও হতে পারে) ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়···ঝড়ের কেন্দ্রে যে চোখ থাকে, তার আশপাশেই সেই ভয়ানক ঘূর্ণি···বাতাসের চক্রের মতো আর কি!
বিষয়টা সম্পর্কে ব্রেনওয়াশ কোচিং সেন্টারের পরিচালকের ব্যাখ্যা শুনে সবাই টাসকি খেয়ে যায়। তবে না, সবাই একমত যে এখনো কোথাও মাংস-বৃষ্টির কথা কোনো খবরের কাগজে বের হয়নি।
– তাহলে তিনি এখনো বাতাসের ঘূর্ণির মধ্যেই আছেন?
– মানে?
– মানে ওই যে বললাম, ঝড়ের কেন্দ্রে যে চোখ থাকে তার চারপাশের বাতাসের ঘূর্ণির মধ্যে ঘুরছেন, হয়তো এখনো ছিন্নভিন্ন হননি। তবে বাতাসের ঘূর্ণিত চক্রের মধ্যেই ঘুরছেন।
– ঘূর্ণিত চক্র?
– আচ্ছা আকাশের কোন স্তরে এই চক্র? আরেকজন অতি উৎসাহী জানতে চান।
– বলা মুশকিল, মনে হয় তৃতীয় স্তরে,
ট্রাটোস্কেয়ারে হতে পারে···ঝড়ঝক্কা তো সব ওই স্তরেই হয় বলে শুনেছি।
– আচ্ছা, উনার কাছে কি মোবাইল ফোনসেট ছিল?
আরে তাই তো, উনার মোবাইলে একটা ফোন দিলেই তো হয়। সবাই হায় হায় করে উঠল, এই সামান্য বুদ্ধিটা কারও মাথায় আসেনি কেন? তাঁর মোবাইল ফোন নম্বরটা কত?
দেখা গেল তাঁর মোবাইল ফোন নম্বরটা কারও কাছে নেই। আশ্চর্য, এলাকার একজন চিরকুমার, সবার সুখে-দুঃখে এগিয়ে আসেন, অথচ তাঁর মোবাইল নম্বরটা কারও কাছে নেই? এটা হতে পারে না। উপস্থিত আড্ডার সবাই ভেতরে ভেতরে অত্যন্ত লজ্জিত হলেন বলে মনে হলো।
তবে না, পরদিন এলাকার মোবাইল ফোন ফ্লেক্সিলোড সেন্টারে খোঁজখবর করে তাঁর নম্বরটা বহু কষ্টে পাওয়া গেল এবং ফোন দেওয়া হলো সঙ্গে সঙ্গেই···রিং হচ্ছে··· রিং হচ্ছে···কিন্তু ধরছে না। আবার করা হলো। এবারও রিং হচ্ছে, রিং হচ্ছে···ধরছে না কেউ!
অবশ্য ট্রাটোস্কেয়ারে ঘুরন্ত অবস্থায় বাতাসের ঘূর্ণিত চক্রে কি উনি ফোন রিসিভ করতে পারবেন? কিংবা নেটওয়ার্ক থাকবে ওখানে? বলা মুশকিল। দান দান তিন দান। তৃতীয়বারের বার কেউ ফোন ধরল বলে মনে হলো।
– ধরছে···ধরছে···হ্যালো?
– কে? (করিম সাহেবের গলা)
– ক-করিম সাহেব, আপনি কোথায়?
– আমি চক্রে।
– সর্বনাশ!···উনি সত্যি সত্যিই বাতাসের ঘূর্ণিত চক্রের মধ্যে পড়েছেন···
– দেখলেন, বলেছিলাম না? বিজ্ঞের হাসি দিয়ে ব্রেনওয়াশ কোচিং সেন্টারের পরিচালক মোতাব্বের মোবাইল ফোনসেটটা এক রকম ছিনিয়েই নেন।
– আপনি এখন কোন স্তরে?
– তৃতীয় স্তরে উঠেছিলাম, কিন্তু তোমাদের কারণে আর পারলাম না···বলে ফোনের সংযোগ কেটে দিলেন আব্দুুল করিম সাহেব।
– মনে হয় এই মাত্র তিনি ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলেন···চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন ব্রেনওয়াশ কোচিং সেন্টারের পরিচালক। অন্যরা হায় হায় করে উঠলেন। এলাকার একজন সুসন্তান আমরা হারালাম।
আর তখনই করিম সাহেবের দরজায় শব্দ হলো। সবাই মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখেন, তিনি, মানে আব্দুল করিম সাহেব দরজা খুলে বের হয়ে আসছেন। গায়ে গেরুয়া রঙের একটা চাদর, হাতে মোবাইল ফোনসেট। ভ্রূ জোড়া অতিমাত্রায় কুঞ্চিত, বিরক্ত।
বলাই বাহুল্য, তিনি মেডিটেশনে বসেছিলেন। গামা আলফা লেভেল পার হয়ে তামা লেভেলে···প্রায় পৌঁছেও গিয়েছিলেন কিন্তু পাড়ার ছেলেপেলের জন্য এ যাত্রায় সম্ভব হলো না।
আহসান হাবীব
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ১৩, ২০০৯
Leave a Reply