মাঝারি গোছের চাকুরে ইমরান আহমেদ। ত্রিশের ওপর বয়স। রোজ রোজ দাড়ি-গোঁফ কামানোর ঝামেলাটা তিনি নিজেই পোহান। কিন্তু চুল ছাঁটাতে নরসুন্দরের কাছে ধরনা না দিয়ে উপায় কী?
বাসা থেকে কিঙ্কর শীলের সেলুন হাঁটা দূরত্বের পথ। চুল ছাঁটতে তাই মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সেখানে গিয়ে হাজির হন ইমরান। সকাল নয়টার মতো বাজে, এর মধ্যে সেলুনের কাঁচি, ক্ষুর ও চিরুনিগুলো সচল হয়ে উঠেছে। সেলুনের চারটি চেয়ারেই গ্যাঁট হয়ে আছে খদ্দের। তবে ইমরান সাহেবের হতাশ হওয়ার কারণ নেই। এ মুহূর্তে সেলুনের অপেক্ষমাণ খদ্দের বলতে তিনি একাই।
ইমরানকে দেখে পান রাঙানো দাঁত বের করে কিঙ্কর বলে, ‘আদাব, দাদা। ভাবি আর ছেলেটা ভালো তো? দুই মিনিট বসেন, পত্রিকা পড়েন।’
তোতা পাখির মতো কথাগুলো আওড়ায় কিঙ্কর। অভ্যাসবশে অকারণে ক্যাঁচাক্যাঁচ শব্দে কাঁচি চালায় সে। মন দেয় খদ্দেরের চুল ছাঁটায়। ইমরান এক নজর দেখেই বোঝেন, কাজটা কেবল ধরেছে কিঙ্কর। নির্ঘাত মিনিট বিশেকের ফের। তা লাগুক। পত্রিকা পড়তে পড়তে চলে যাবে এটুকু সময়।
কিঙ্করের দোকানে একাধিক পত্রিকা রাখা হয়। সবই স্বল্পমূল্যের দৈনিক। এসব পত্রিকা রেখে এক ঢিলে দুই পাখি মারে সে। খদ্দেরের সময় কাটে, একই সঙ্গে চুল-দাড়ির জঞ্জাল নিকেশের অবলম্বন হয়। স্রেফ সময় পার করতেই একটা পত্রিকা তুলে ওল্টাতে থাকেন ইমরান। এমন সময় দ্বিতীয় খদ্দেরের আগমন ঘটে। ইমরানের পাশের আসনটি সে দখল করে নেয়। তাকেও সাদর সম্ভাষণ জানায় কিঙ্কর। তা দেখে ইমরানের উসখুস শুরু হয়। কিঙ্কর এ সেলুনের সেরা ক্ষৌরকার। কাজেই খদ্দেররা তাকে দিয়েই কাজ সারাতে চায়। লোকটার সঙ্গে কিঙ্করের বেশি খাতির কিনা কে জানে। কথায় বলে ‘নাপতে বুদ্ধি’। পছন্দের লোককে আগে সুযোগ দিতে কিঙ্কর এমন প্যাঁচ কষবে, তা উতরানো ইমরানের কম্ম নয়।
লোকটা যাতে কিঙ্করের কাছ থেকে কোনো সুবিধা বাগাতে না পারে, এ জন্য কৌশলে নিজের অগ্রাধিকারের বিষয়টি জানান দেন ইমরান। তিনি বলেন, ‘কই কিঙ্করদা, তোমার দুই মিনিট শেষ হতে আর কতক্ষণ লাগবে?’
‘আরেকটু কষ্ট করেন, দাদা। এই তো হইয়া আসছে।’
কমপক্ষে আরও ১০ মিনিট অপেক্ষা। তা হোক, ইমরানের কৌশল কাজে লেগেছে। অপেক্ষমাণ দ্বিতীয়জন আরেক ক্ষৌরকারের উদ্দেশে বলে, ‘অবিনাশ দা, এর পরই কিন্তু আমি।’
অবিনাশ কথা না বলে হাসে। হাসিতে সম্মতি। সেলুনে কিঙ্করের পরই অবিনাশের স্থান। লোকটা তা ভালো করে জানে। বাকি দুই ক্ষৌরকার কার্তিক ও শিবুর মধ্যে প্রথম জনের চুল ছাঁটা তবু মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু শিবুর হাতে পড়লে আর রক্ষা নেই। ইমরানকে ফুসলে একবার চুল কাটার যন্ত্র দিয়ে ‘কঠিন’ এক ছাঁট দিয়েছিল সে। বাড়ি ফেরার পর গিন্নি রেগে আগুন, ‘তোমার এ সর্বনাশ করল কে? হাটবাজারে পকেটমার ধরা পড়লেও তো এ অবস্থা হয় না!’
সেই থেকে শিবু সম্পর্কে ইমরান সতর্ক। অন্যরাও যে সতর্ক, এর জোরালো প্রমাণ মিলল আরেকজন খদ্দেরের আগমনে। সেও নির্দ্বিধায় শিবুকে বাদ দিয়ে কার্তিককে রাজি করাল তার জন্য। এর মধ্যে অনেকখানি সময় পার হয়ে গেছে। শেষ হয়ে এসেছে কিঙ্করের খদ্দেরের চুল ছাঁটা। কাঁচি আর সরু চিরুনির শেষ ধাপ চলছে ঝুপোচুলোর মাথায়। সহসা একটা বাজখাঁই কণ্ঠ!
‘কী রে কিঙ্কইরা, তোর গায়ে আইজকাইল মনে হয় চর্বি জইমা গেছে!’
শুধু কিঙ্কর নয়, সেলুনের সব মানুষ এ কণ্ঠে হকচকিয়ে যায়। কারুকাজ করা লাল পাঞ্জাবি পরা এক মোছুয়া সেলুনের সামনে দাঁড়িয়ে। বিশাল বপুর সামনে পেল্লাই ভুঁড়ি। ভুঁড়িওয়ালা এ মহল্লায় অতি পরিচিত। তার আঙ্গুলের তুড়িতে অনেক কিছু হতে পারে, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মঙ্গলজনক নয়।
ভুঁড়িওয়ালার ধমকে চিরুনি-কাঁচি পড়ে গেল কিঙ্করের হাত থেকে। এমনভাবে সে হাসল, যেন বহু কষ্টে একটা বেগ সামলাচ্ছে।
‘কাইল যে খবর দিলাম, বাসায় গেলি না ক্যান?’
‘শরীরটা খারাপ ছিল, দাদা। আজ যাব।’
‘যাব কী রে ব্যাটা, এখনই যা। পোলাটা অপেক্ষা করতাছে।’
‘এখনই যাইতেছি, দাদা।’
এই বলে সত্যি সত্যি চুল কাটার সরঞ্জাম নিয়ে কিঙ্কর রওনা হলো ভুঁড়িওয়ালার বাড়ির দিকে। ইমরান পড়ে গেলেন মহা মুশকিলে। শূন্য থেকে আছাড় আর কি! বাকি তিন নরসুন্দরের মধ্যে অবিনাশ আর কার্তিক দখল হয়ে গেছে। বাকি আছে শিবু। ইমরানকে এখন শিবুর হাতেই চুল কাটাতে হবে। এর মধ্যে শিবুর কাজও শেষ হয়ে এসেছে। আর তিন-চার মিনিট লাগবে। এমন সময় এক মুঠি আশার আলো নিয়ে আরেকজন খদ্দের হাজির।
হঠাৎ কোনো জরুরি কাজের কথা মনে পড়েছে, এমন ভঙ্গিতে সেলুন থেকে বেরিয়ে আসেন ইমরান। মনে মনে নতুন খদ্দেরের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘যা বেটা, ছিল্লা মুরগি সাজ গে শিবুর হাতে।’
ইমরান মিনিট দশেক কাটানোর মতো একটা উপায় খুঁজতে থাকেন। এর মধ্যে নতুন খদ্দেরকে বসিয়ে সাদা কাপড়ে আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে চুল কাটা শুরু করবে শিবু। ইমরানকে আবার বসে থাকতে হবে অবিনাশ বা কার্তিকের হাত খালি হওয়ার আপেক্ষায়। তবু ভালো। শিবুর হাতে ‘পকেটমার’ সাজার চেয়ে তো ভালো।
একটা চায়ের দোকানে ঢুকে পড়েন ইমরান। মিনিট দশেক পার করে দেন চা পানে। তারপর আড়মোড়া ভেঙে বেরিয়ে আসেন। এবার একটু পা চালিয়েই হাঁটেন তিনি। দেরি হলে ভিড়ের চক্করে পড়তে হবে। তখন অপেক্ষার পালা বেড়ে যাবে আরও।
সেলুনে ঢুকে হকচকিয়ে যান ইমরান। ওকে দেখা মাত্র একটা উল্লাস উথলে উঠেই থেমে যায়। শিবু দাঁত বের করে বলেন, ‘আসেন দাদা, আসেন। আপনার জন্য তেনাদের আটকাইয়া রাখছি। কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না আপনে ফিরা আসবেন।’
সেলুন এরই মধ্যে ভরে উঠেছে খদ্দেরে। তাদের মধ্যে কয়েকজন রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে ইমরানের দিকে তাকিয়ে। কাঁধের তোয়ালে দিয়ে শিবু খদ্দেরের আসন ঝাড়তে ঝাড়তে ইমরানকে আবার আমন্ত্রণ জানায়, ‘কী হইল দাদা, আসেন। অনেক কাস্টমার অপেক্ষা করতাছে।’
ইমরানের ইচ্ছা নেই, তবু পা দুটো তাকে টেনে নিয়ে যায় শিবুর দখলে থাকা আসনটির দিকে।
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ১৩, ২০০৯
Leave a Reply