ওই যে মেয়েটি, শিল মাছের চামড়ার কোট গায়ে দিয়ে ঘোরে। ওকে সবাই জানে, বেশ শান্ত-শিষ্ট, অবলা। কিন্তু সময় বদলায়, সেই সঙ্গে মানুষও বদলায়।
একবার মস্কোর গণ-আদালতে একটি মামলা উঠেছিল। একটি মেয়ের হ্যান্ডব্যাগ ছিনতাইয়ের অপরাধে একটি যুবক ধরা পড়েছিল। মামলা তারই বিরুদ্ধে। অবশ্য ছিনতাইকারী যুবক তার দোষ স্বীকার করেছিল।
আদালতে জজ সাহেবকে সে অকপটে বলেছিল, ‘হুজুর, আমি পায়রা পুষে থাকি। পাড়ার ছেলেরা আমার একটা দামি টারম্যান পায়রার সঙ্গে তাদের বাজে পায়রা মিশিয়ে দিয়ে সেটা হাতিয়ে নিয়েছে বুঝতে পেরে আমার খুব রাগ হলো। আবার একটা কিনতে হবে। আমি তাই আমার বন্দুকটা নিয়ে পাড়ার গলিতে ঢুকলাম। অবশ্য কাউকে জখম করার মতলব ছিল না আমার। হঠাৎ নজরে পড়ল এক সুবেশা তরুণী, হাইহিল জুতো পরা, ব্যাগ ভর্তি কী যেন নিয়ে চলেছে। গায়ে শিলের চামড়ার কোট। ওর হাতে একটা হ্যান্ডব্যাগও রয়েছে। আমার মনে হলো, আমি যদি ওকে ভয় দেখাই, তবে ও ভয়ে বসে পড়ে চিৎকার শুরু করবে। আর মজা করতে আমি তা-ই চাই।’
এই পর্যন্ত বলে যুবকটি আদালতে বসা সুন্দরী মেয়েটিকে দেখাল, ‘ওই যে কোট গায়ে বসে আছে, ওই মেয়েটি।’
আবার বলতে লাগল আসামি যুবক। ‘ওই মেয়েটি সামনের একটা বাড়ির সদর দরজার কাছে দাঁড়াল কলবেলটা টেপার জন্য-হ্যাঁ, ওর ওই বাঁ হাতের কড়ে আঙুল দিয়ে। আর বড় ব্যাগটা ওর হাতেই রইল। হাতে ছোট হ্যান্ডব্যাগটা থাকায় বেল টিপতে অসুবিধে হবে দেখে ও ব্যাগটা মাটিতে নামিয়ে রাখল। আমি সেই ফাঁকে চুপিসারে ওর পেছনে গিয়ে চট করে ব্যাগটা নিয়েই দে চম্পট। রাস্তায় কোনো লোক ছিল না। আমি বেশ খানিকটা দৌড়ে এসে পেছন ফিরে দেখি ওই মেয়েটাও আমার পিছু নিয়েছে। হাতের বড় ব্যাগটা রেখে দিয়ে আমার পেছনে দৌড়াচ্ছে। ভালো করে যাতে দৌড়াতে পারে তাই কোটের সামনের বোতামগুলো খুলে দিয়েছে। তবুও ও মেয়েছেলে, আমার সঙ্গে পারবে কেন দৌড়ে।
আমি আরও জোরে দৌড়াতে লাগলাম। সামনে একটা ইটের প্রাচীর দেখে তার ওপরে লাফিয়ে উঠলাম। প্রাচীরটা, হুজুর, খুবই সরু ছিল। আপনিও চলতে গেলে উল্টে পড়ে যেতেন। কিন্তু আশ্চর্য, প্রাচীরে উঠে দেখি ওই মেয়েটাও প্রাচীরে উঠে আমাকে ধাওয়া করছে। তখন কী করি? প্রাচীরের ওদিকে ছিল একটা ডাস্টবিন। পড়িমরি করে লাফ দিয়ে পড়লাম ওই ডাস্টবিনের মধ্যে। কাছেই ছিল একটা গুদাম। তাড়াতাড়ি উঠলাম তার চালের ওপর। এবার মনে মনে ভাবলাম, এইবার ঠিক জব্দ। একে মেয়েছেলে, তার ওপর পায়ে ছিল হাই হিল জুতো। গায়ে চামড়ার কোট, কাজেই আর এগোতে হচ্ছে না বাছাধনকে। কিন্তু বলব কী, হুজুর, ওই মেয়েটি প্রাচীর থেকে দিব্যি ঝাঁপ দিল ওই ডাস্টবিনের মধ্যে। আবার সেখান থেকে বেরিয়ে ও-ও উঠল গুদামের চালে। অবশ্য সে জন্য ও ওর পরনের স্কার্টটাকে একটু তুলে ধরেছিল মাত্রই। বুঝুন, চালটা প্রায় আট নয় ফুট উঁচু। তখন কী করি, দিলাম ঝাঁপ গুদামের চাল থেকে। যাক, এবার বাঁচোয়া। ছাই! দেখি ওই মেয়েটাও চাল থেকে লাফিয়ে পড়েছে। ওর জুতোর হিল দুটিই ভেঙে গেল। তাতে ওর আরও ভালো হলো। আমি প্রাণপণে ছুটতে ছুটতে পেছন ফিরে দেখি ও-ও ঠিক দৌড়াচ্ছে আমার পেছনে পেছনে।
এ তো মহা বিপদ হলো! হাঁপিয়েও পড়েছি। আর যেন দৌড়াতেও পারছিনে। এখুনি হয়তো হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাব। যাক, দেখলাম কাছেই পাহাড়-প্রমাণ কয়লা গাদা করা রয়েছে এক জায়গায়। আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে কয়লার ঢিপির একটা গর্তের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে লুকোলাম। যাক, মেয়েটা আর আমাকে খুঁজে পাবে না। ভুল। ঠিক, আমাকে খুঁজে বের করল ওই মেয়েটা। হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে হিড়হিড় করে টেনে বের করল আমাকে কয়লার ঢিবির গর্ত থেকে। আর এইসা চেপে ধরল আমাকে যে অনেক চেষ্টা করেও ওর হাত থেকে ছাড়া পেলাম না আমি। তারপর আর কী, আমাকে টেনে নিয়ে হাজির করল থানায়।’
গণ-আদালতের হাকিম তাঁর গোঁফের আড়ালে মৃদু হেসে পায়রা কারবারি যুবকটির কথা সব শুনলেন। তারপর বাদী মেয়েটিকে বললেন, ‘তোমার কিছু বলার আছে?’ মেয়েটি উত্তরে বলল, ‘ওই আসামি যা বলেছে সবই সত্যি।’ তারপর ব্যঙ্গ করে বলল, ‘ওই ছোড়া আমার কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। সেটাই আমার আত্মসম্মানে লেগেছিল। যদি আমার পায়ে হাই হিল জুতো না থাকত আমি হলপ করে বলতে পারি প্রথম ৫০ ফুটের মধ্যেই ওকে আমি পাকড়াও করে ফেলতাম। আমি কয়েক বছর ধরেই স্পোর্টসে সব বিষয়ে বিজয়িনী চ্যাম্পিয়ন।’
মেয়েটি তার নাম বলতেই আদালতের সবাই চমকে উঠল। সোভিয়েত স্পোর্টস ক্লাবের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদ ওই চামড়ার কোট গায়ে নিরীহ দেখতে মেয়েটি।
অনুবাদঃ কুমারেশ ঘোষ
মাত্ভেই রাইসমানঃ রাশিয়ান লেখক।
সূত্রঃ প্রথম আলো, এপ্রিল ০৬, ২০০৯
Leave a Reply