খবরটা শোনার পর থেকে একদমই শান্তি পাচ্ছিলেন না ফরিদ সাহেব। খুবই দুশ্চিন্তা হচ্ছিল তাঁর। তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করতে করতে তাঁর স্ত্রী ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু ফরিদ সাহেবের চোখে ঘুম নেই। ঘুম আসবে কী করে, পৃথিবী যেমন সূর্যের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে, তাঁর মাথায় তেমনি ঘুরপাক খাচ্ছে দুশ্চিন্তা। ফরিদ সাহেবের দুশ্চিন্তার কারণ তাঁর একমাত্র মেয়ে। মেয়ে ঢাকার রোকেয়া হলে থেকে লেখাপড়া করে। লেখাপড়ার সুবিধার জন্য কদিন আগেই মেয়েকে একটা কম্পিউটার কিনে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ নাকি এক রুমে একটার বেশি কম্পিউটার রাখতে দেবে না। হলে নাকি কম্পিউটারবিরোধী অভিযান চলছে। এর কোনো মানে আছে! তিনি নিজে ঢাকায় গিয়ে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে মেয়েকে কম্পিউটার কিনে দিয়েছেন। নাহ! এর একটা বিহিত করতেই হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা বলবে, অথচ হলে কম্পিউটার রাখতে দেবে না, এটা তো হতে পারে না। কম্পিউটার রাখার জন্য কি আলাদা বাসা ভাড়া করবে নাকি···? ফরিদ সাহেবের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। কল রিসিভ করতেই শোনা গেল তাঁর মেয়ের গলা-হ্যালো বাবা, সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। এখন থেকে এক রুমে তিনটা কম্পিউটার রাখার অনুমতি দিয়েছে। তিনটার বেশি কম্পিউটার থাকলে যে রুমে কম্পিউটার নেই সেই রুমে সিট দেওয়া হবে।
মেয়ের কথা শুনে ফরিদ সাহেবের সব দুশ্চিন্তা উধাও হয়ে গেল। যাক! কম্পিউটার কেনাটা তাহলে বৃথা যায়নি। তিনি খুশি মনে বারান্দায় চলে এলেন।
ফরিদ সাহেবের মাথা এখন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। তিনি পায়ের ওপর পা তুলে আরাম করে খবরের কাগজ পড়ছেন। হঠাৎ তাঁর চিন্তা করার মুড চলে এল। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর আজকাল প্রায়ই তাঁর চিন্তা করার মুড চলে আসে। তিনি ভাবতে লাগলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো যেনতেন লোক নয়। এরা না বুঝে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তা ছাড়া তিনি শুনেছেন, ওখানে পানি-বিদ্যুতের তেমন সমস্যাও নেই। তাহলে এ রকম একটা সিদ্ধান্ত তারা নিল কী করে? এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো উচ্চমার্গীয় কারণ আছে। ব্যাপারটা শেয়ার করার জন্য তিনি তাঁদের কাজের লোক আবুলকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা আবুল, বল তো রুম থেকে ওরা কম্পিউটার কেন সরিয়ে নিল?’
আবুল হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে বলল, ‘এইটা তো একদম ইজি বিষয় খালুজান, জিনিসটার নামেই তো ‘কম’ আছে। এইটা তো কম থাকাই ভালো।’
আবুলের কথা শুনে বিরক্তিতে ফরিদ সাহেবের কপাল কুঁচকে গেল। দেশের কাজের লোক সম্প্রদায়ের জ্ঞানের পরিধি দেখে তিনি খুবই ব্যথিত হলেন। চিন্তার মুডে না থাকলে কষে একটা চড় দিয়ে তিনি আবুলের দাঁত ফেলে দিতেন। তিনি আবার গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন। প্রথমেই স্থানের বিষয়টা তাঁর মাথায় এল। রোকেয়া হল তো বিশাল ফিউচার পার্ক নয় যে যার যে কম্পিউটার আছে তা-ই এখানে নিয়ে আসবে। এখানে জায়গা কম, তাই কম্পিউটারও কম। ফরিদ সাহেব কর্তৃপক্ষের কথাই যখন ঠিক বলে ধরে নিয়েছেন, তখনই তাঁর মাথায় এল ল্যাপটপের কথা। ‘জায়গা কম’ এটাই যদি মূল কারণ হয়, তাহলে তো ল্যাপটপ রাখতে নিষেধ করার কথা নয়। ল্যাপটপ তো বালিশের চেয়েও ছোট। তাহলে কারণটা কী? ফরিদ সাহেবের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কারণটা সম্ভবত তিনি বুঝতে পেরেছেন। প্রাণপ্রিয় কম্পিউটার জব্দ করলে ছাত্রীরা মনের দুঃখে হল ছেড়ে দেবে। তখন কর্তৃপক্ষ তাদের পছন্দমতো নতুন ছাত্রী ভর্তি করতে পারবে। একেবারে পানির মতো সহজ কারণ। কিন্তু···পরে তো আবার কম্পিউটার রাখার সিদ্ধান্ত দিয়েছে। নাহ। এ কারণটাও জুতসই হলো না। হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ল খবরের কাগজে। চীনা এক গোয়েন্দা সংস্থা নাকি পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ কম্পিউটারগুলোতে প্রবেশ করে বহু গুরুত্বপূর্ণ নথি হাতিয়ে নিয়েছে। রোকেয়া হলও তো অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা। চীনারা এখানকার কম্পিউটারে হামলা চালাতে পারে, এটা ভেবেই হয়তো কম্পিউটারগুলো সরিয়ে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি বুঝলেন, চীনারা কাজটা করেছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। রোকেয়া হলের সব কম্পিউটারে তো আর ইন্টারনেট নেই। তা ছাড়া হামলার আশঙ্কা করলে তো সব কম্পিউটারই সরিয়ে নিত। সব রুমে একটা করে রেখে দিত না। ফরিদ সাহেবের মেজাজ খারাপ হতে শুরু করল। চীনারা বোঁচা নাক নিয়ে এত কিছু কীভাবে করে, তা তাঁর মাথায়ই এল না। তাঁর নিজের নাকও বোঁচা। কই, তিনি তো কম্পিউটারের ক-ও বোঝেন না। তা ছাড়া কম্পিউটার সরানোর আসল কারণটাও তিনি বের করতে পারছেন না।
হঠাৎ আবুল বলল, ‘খালুজান, আমার মনে হয় হলের আপাগো মধ্যে কোনো মিলমিশ নাই। তারা নিজের কম্পিউটার নিয়ে নিজের মতো থাকে। এর জন্যই একটা রাইখা বাকিগুলা সরায়া দিছে।’
আবুলের কথা শুনে তার প্রতি শ্রদ্ধা চলে এল ফরিদ সাহেবের। এই সামান্য ব্যাপারটা তাঁর মাথায়ই আসেনি। প্রধানমন্ত্রী নিজে পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে বলেছেন, অথচ হলের মেয়েদের মধ্যে ঐক্য থাকবে না, এটা কেমন কথা! হল কর্তৃপক্ষের বুদ্ধি আছে বলতে হবে। এক রুম এক কম্পিউটার। সবাই মিলেমিশে এক কম্পিউটার ব্যবহার করলে সময়জ্ঞান, দায়িত্বজ্ঞান ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হবে। এতে মেয়েদের মধ্যে একতাও বাড়বে আবার বিদ্যুৎও কম খরচ হবে। আহা! কী অসাধারণ বুদ্ধি। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার এই পরিকল্পনায় ফরিদ সাহেব চমৎকৃত হলেন। তা ছাড়া আসল কারণটা বুঝতে পেরে তাঁর মনটাও আনন্দে ভরে গেছে। কিন্তু এখন তো আবার সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছে। এক রুমে শুধু তিনটা কম্পিউটারই নয়, কারও ল্যাপটপ থাকলে সেটাও রাখা যাবে। নাহ! এ জাতিকে আর ঐক্যবদ্ধ করা গেল না। ফরিদ সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
আদনান মুকিত
সূত্রঃ প্রথম আলো, এপ্রিল ০৬, ২০০৯
Leave a Reply