ঢাকায় থাকিতে আসিয়া আবাসনসংক্রান্ত জটিলতায় যাঁহারা পতিত হইয়াছেন, তাঁহাদের উদ্দেশে এই রচনাখানি নিবেদিত। ভাড়া বাড়ি, বিশেষত মেসবিষয়ক কিছু কাহিনী আপনাদের সম্মুখে পাড়িতে চাই। ঘটনা যদি আপনার জীবনের সহিত মিলিয়া যায়, তাহার দায়ভার আপনার, এই লেখকের নহে!
প্রথমেই মনে পড়িতেছে আমার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর কাহিনী। আমরা তখন সদ্য ঢাকায় আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হইবার নিমিত্তে কোচিং গ্রহণ করিব। আমি আশ্রয় পাইয়াছিলাম আমার এক নিকটাত্মীয়ের বাড়িতে। আমার বন্ধুটি একটি মেসের সদস্যপদ জোগাড় করিতে পারিয়াছিল। কোচিংয়ে প্রতিদিনই পরীক্ষা লাগিয়া থাকিত। বন্ধুটি পরীক্ষায় ক্রমাগত খারাপ করিতে লাগিল। একদিন তাহাকে শুধাইলাম, ‘মেসে পড়ালেখার কি বিশেষ অসুবিধা?’ বন্ধুটি বিরস মুখে বলিল, ‘আর বলিয়ো না। প্রতিদিন বাড়ি খুঁজিয়া পাইতেই তো আড়াই-তিন ঘণ্টা সময় অপচয়।’ প্রতিদিন কার বাড়ি খোঁজে সে? বুঝিতে না পারিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘প্রতিদিন এত কার বাড়ি খোঁজো?’ বন্ধু নির্বিকারভাবে বলিল, ‘কেন, আমার!’
বন্ধুটিকে লইয়া সেদিন হাস্যপরিহাস করিয়াছিলাম। কিন্তু কী বলিব, বছর পাঁচেক পর একই দুর্দশা আমারও হইয়াছিল। মাস তিনেক আত্মীয়ের বাসায় কোচিং করিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অবতীর্ণ হই। তাহার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি বছর প্রজাপতির মতো কীরূপে উড়িয়া গিয়াছিল, ঠাহর পাই নাই। সংবিৎ হইল বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছাড়িয়া দিয়া যখন মিরপুর ২ নম্বরের মাকড়সার জালের মতো অলিগলিসমৃদ্ধ এলাকাটিতে মাথা গুঁজিলাম। সেই বাড়িতে আমার সঙ্গী হইল কোচিংয়ের সেই বন্ধু। এত দিনে সে রাস্তাঘাট বহু চিনিয়াছে। মিরপুরের এই মাকড়সা গলিও তাহার কাছে হস্তরেখার মতো আটপৌরে ব্যাপার। কিন্তু বিপদে পড়িলাম আমি। প্রায়শ বাড়ি খুঁজিয়া পাই না। অনেক দিকচিহ্ন মুখস্থ রাখিতে হয়। তাহার পরও প্রায়-প্রায়ই অফিস হইতে সন্ধ্যায় সেই অলিগলিতে ঢুকিয়া বাড়ির গলিটির আর সন্ধান করিতে পারি না। কিন্তু কাহারেও মুখ ফুটিয়া এই বিপদের কথা বলিতে পারি না; সেই বন্ধুটিকে তো নয়ই। পাছে সে পাঁচ বছর আগে হাসা আমার সেই হাসিটির বদলা নিয়া ফেলে!
এইবার একটু হাওয়ার গল্প করি। ইয়ামিন নামের আমার এক বন্ধু ঢাকায় আসিয়া ফার্মগেট এলাকায় একটি কক্ষ ভাড়া লইয়াছিল। কক্ষটি ছিল তাহার পরিচিত এক বড় ভাইয়ের ফ্ল্যাটের অংশবিশেষ। নাগরিক পরিভাষায় এইরূপ ব্যবস্থাকে ‘সাবলেট’ বলিয়া থাকে। ইয়ামিন যখন সেই কক্ষটিতে উঠিল, দেখিতে পাইল, একটি সিলিংফ্যান ছাদ হইতে ঝুলিতেছে। দুইটি মাস সেই কক্ষে অতিবাহিত করিল সে। সিলিংফ্যানের বাতাসও খাইল পুরাদমে। দুই মাস পর, তৃতীয় মাসে বড় ভাইকে ইয়ামিন বলিল, ‘ভাইয়া, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সুযোগ পাইয়াছি। কক্ষটি ছাড়িয়া দিতে চাই।’ বড় ভাই বলিলেন, ‘তোমার তো কিছু বকেয়া রহিয়াছে।’ ইয়ামিন ভাবিল, বকেয়া থাকিবার তো কথা নহে। মাসের ভাড়া আগেই পরিশোধ করা হইয়াছিল। কিছু বুঝিয়া উঠিতে না পারিয়া বড় ভাইয়ের পানে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাইয়া থাকিল সে। বড় ভাই বলিলেন, “ভ্রাত, তোমার কক্ষে একটি সিলিংফ্যান রহিয়াছে। যদিও ফ্যানটি তোমার নহে, তথাপি দুই মাসকাল তুমি ইহার হাওয়া খাইয়াছ। অতএব, এই বাবদ তোমার নিকটে পাওনা হইয়াছে। ‘ব্যবহারমূল্য’ হিসাবে তোমাকে পাঁচ শত টাকা পরিশোধ করিতে হইবে।” ইয়ামিন প্রথমে ভাবিয়াছিল, বড় ভাই রঙ্গ করিতেছেন। কিন্তু একটু পরেই বুঝিল, ঘটনা ভিন্ন। পরিশেষে, দরাদরির পর, ‘বাতাসের দাম’ হিসাবে দুই শত টাকা পরিশোধ করিয়া আমার বন্ধু ইয়ামিন উদ্ধার পাইল।
আবাসনসংক্রান্ত সর্বশেষ গল্পটি আমার চল্লিশোর্ধ্ব এক বড় ভাইয়ের। ইহা তাঁহার প্রথম জীবনের গল্প। ঢাকার কাঁঠালবাগানে একটি মেস ভাড়া লইয়াছিলেন। কয়েকজন বন্ধু মিলিয়া থাকিবেন। মেসে উঠিয়া, উত্তরাধিকারস্বরূপ তাঁহারাও একখানি বস্তু পাইলেন। আর কিছু নহে, প্রমাণ আকৃতির একখানি প্রস্তরখণ্ড। এটি কী উদ্দেশ্যে আনীত হইয়াছিল, তাঁহারা ঠাহর করিতে পারিলেন না। তবে এই প্রস্তরখণ্ডই একদিন তাঁহাদের বিশেষ উপকারে লাগিয়া গেল। ঘটনা এইরূপঃ রাত্র ১১ ঘটিকার পর হইতে তাঁহাদের মেস যে তলায়, তাহার উপরের তলা হইতে একটানা শব্দ ভাসিয়া আসিতে লাগিল। একটানা, বিরক্তিকর, কোনো কিছুতে আঘাত করিবার গুমগুম শব্দ। মেসের কেহই কোনো কাজে মনোনিবেশ করিতে পারিতেছিলেন না; নিদ্রা তো অসম্ভব ব্যাপার। অবস্থা বেগতিক হইয়া পড়িলে আমার সেই বড় ভাই মেসের অন্য সদস্যদিগকে বলিলেন, ‘পাথরখানি লইয়া আসো।’ প্রস্তর আনা হইল। এরপর বড় ভাই সবাইকে বলিলেন, ‘মেঝেতে এই পাথর ঘষো।’ সবাই যৌথ প্রচেষ্টায় প্রস্তরখন্ডটি মেঝেতে ঘষিতে লাগিল। বেশ কিছুক্ষণ ঘষার পর নিচের তলা হইতে লোকজন উঠিয়া আসিয়া অভিযোগ করিল, ‘ভ্রাত, এত শব্দ কিসের?’ মেসের সবাই উপরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া সমস্বরে বলিল, উপরে, উপরতলায়! লোকজন উপরতলার পানে ছুটিল!
এইখানে রচনার ইতি টানিতেছি। সকলের সুবুদ্ধি হউক।
তানিম হুমায়ুন
সূত্রঃ প্রথম আলো, এপ্রিল ০৬, ২০০৯
Leave a Reply