ভারতীয় লোককাহিনীর জনপ্রিয় চরিত্র তেনালি রমণ। বিজয়নগরের রাজা কৃষ্ণদেবের রাজসভার আটজন জ্ঞানী ব্যক্তির একজন ছিলেন তিনি। তাঁকে নিয়ে মজার মজার অনেক গল্প রয়েছে। এখানে দুটি গল্প তুলে ধরা হলো।
বীরত্ব
শীতের সন্ধ্যা। মাঠে আগুনের ধারে বসে গল্প করছেন রমণ। সঙ্গে কয়েকজন অবসর নেওয়া সেনাসদস্য। কথায় কথায় তাঁদের গল্প বেশ জমে উঠল। এক সেনাসদস্য তাঁর যুদ্ধের কাহিনী বলতে গিয়ে একাই সাত শত্রুকে ঘায়েল করার রোমাঞ্চকর বর্ণনা দিলেন। আরেক সেনাসদস্য একাই একদল শত্রুকে হটিয়ে দেওয়ার এমন বর্ণনা দিলেন, ফড়ফড়িয়ে সবার গায়ের রোম খাড়া। এভাবে প্রত্যেক সেনাসদস্যই যাঁর যাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন। তাঁদের বর্ণনা অনুযায়ী বীরত্বে কেউ কারও চেয়ে কম নন।
সবশেষে এল রমণের পালা। কিন্তু তিনি তো আর সেনা নন, কাজেই তাঁর যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নেই। তাঁকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে এক সেনা ফস করে বলে উঠলেন, ‘তোমার তো মনে হচ্ছে আমাদের মতো বীরত্বের কোনো কাহিনীই নেই।’
‘থাকবে না কেন,’ তেড়েফুঁড়ে জবাব দিলেন রমণ। ‘আমাকে কী মনে করো তোমরা? লড়াইয়ের তালিম ছিল বলেই তোমরা বীরত্ব দেখাতে পেরেছ। আর আমি তো কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই বীরত্ব দেখিয়েছি।’
‘তা শুনি কী বীরত্ব দেখালে?’ একসঙ্গে সবাই উৎসুক হলেন জানতে।
রমণ বলতে লাগলেন, ‘একদিন সন্ধ্যায় একলা এক বিশাল মাঠের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, এমন সময় বড়সড় এক তাঁবু দেখতে পেলাম। ভারি কৌতূহল হলো। আস্তে করে গিয়ে উঁকি দিলাম ভেতরে। দেখি ভেতরে মাদুরের ওপর পেল্লাই এক দেহ। এত বড় ধড় আর কখনো দেখিনি। বুঝতে আর বাকি রইল না, এ রঘু ডাকাত ছাড়া আর কেউ নয়।’
এই বলে দম নেওয়ার জন্য একটু থামলেন রমণ। অমনি ব্যাকুল শ্রোতারা তাড়া দিলেন তাঁকে, ‘তারপর, তারপর।’
রমণ বললেন, ‘এমন কুখ্যাত ডাকাতকে বাগে পেয়ে কি আর ছাড়া যায়? কোমর থেকে চাকু বের করে তার এক পায়ের বুড়ো আঙ্গুল কেটেই ঝেড়ে দৌড় দিলাম। যা-ই বলো ভাই, সে তো সাধারণ মানুষ নয়। একটা ডাকাত! প্রাণের মায়া কার না আছে?’
শ্রোতারা হতাশ হয়ে বললেন, ‘দূর, এটা কী করলে! পায়ের আঙ্গুল কাটার মধ্যে বীরত্ব আছে কোনো? মাথা কাটতে পারলে না হয় শাবাশ দেওয়া যেত।’
রমণ এবার রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘ও কাজটি করার সুযোগ আর পেলাম কোথায়? আগেই তো কে যেন কাজটা করে গিয়েছিল।’
——————-
বোকার তালিকা
একদিন রাজা কৃষ্ণদেবের কাছে এক ভিনদেশি লোক এলেন। নিজেকে তিনি একজন ঘোড়া বিক্রেতা হিসেবে দাবি করলেন। সঙ্গে নাকি তাঁর কিছু ভালো জাতের ঘোড়া আছে। লোকটা ছিলেন বাকপটু। রাজা সহজেই তাঁর কথায় পটে গেলেন। লোকটার কথামতো হাজার পাঁচেক সোনার মোহর তাঁকে আগাম দিলেন তিনি। রাজাকে শিগগির ঘোড়া এনে দেওয়ার কথা দিয়ে ভিনদেশি চলে গেলেন। দেখতে দেখতে দুটো দিন পার হয়ে গেল, কিন্তু ঘোড়া বিক্রেতার কোনো দেখা নেই।
তৃতীয় দিন রাজা তাঁর বাগানে একাকী ঘুরছেন, দেখেন ঘাসের ওপর উপুড় হয়ে রমণ খুব মন দিয়ে কী যেন লিখছেন। এগিয়ে গিয়ে রাজা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী করছ রমণ?’
রমণ ঝটপট জবাব দিলেন, ‘রাজ্যের সবচেয়ে বোকা লোকদের একটা তালিকা করছি।’
কৌতূহলী হয়ে রাজা জানতে চাইলেন, ‘তা এক নম্বরে স্থান পেল কে?’
‘বেয়াদবি নেবেন না, রাজামশাই। এক নম্বর আসনটি আপনিই দখল করেছেন।’
রমণের ওপর ভয়ানক খেপে গেলেন রাজা। তাঁর রাজসভার সামান্য এক কর্মচারীর এত দূর স্পর্ধা! পেয়াদা ডেকে রমণকে শূলে চড়াতে ইচ্ছা হলো তাঁর। কিন্তু তাঁকে বোকার হদ্দ ঠাওরানোর কারণ আগে জানতে হবে। এ জন্য রাগ চেপে তিনি রমণকে শুধালেন, ‘তা আমাকে সবচেয়ে বেশি বোকা ঠাওরানোর কারণটা কী?’
রমণ বললেন, ‘যে মানুষ অপরিচিত এক লোকের কথায় ভজে অবলীলায় পাঁচ হাজার সোনার মোহর দেন এবং তাঁর কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশা করেন, তিনি বোকা নন তো কী?’
‘কিন্তু ওই লোক যদি সত্যি সত্যি ঘোড়া নিয়ে ফিরে আসে, তখন? সময় তো আর চলে যায়নি।’
রমণ তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এর সমাধান তো খুব সহজ, রাজামশাই। সে ক্ষেত্রে আপনার নাম মুছে ওই তালিকার শুরুতে ঘোড়াওয়ালার নাম বসিয়ে দেব।’
— ইংরেজি থেকে ভাষান্তর শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ২৩, ২০০৯
Leave a Reply