আমাদের বুড়ো পোস্টমাস্টার স্যাদকোপেজভের স্ত্রী-বিয়োগের পর তাঁর স্ত্রীকে কবরে পাঠিয়ে আমরা পোস্টমাস্টারের ঘরে সমবেত হয়েছিলাম প্রচলিত প্রথামতো মৃতের আত্মার স্মরণে।
কিন্তু যেইমাত্র টেবিলে ‘প্যানকেক’ সাজানো হলো, সদ্য-পত্নীহারা বৃদ্ধের শোক যেন উথলে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন, ‘ওই প্যানকেক দেখে আমার স্ত্রীর কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে গো। সে ছিল এমনই সুন্দর···’
আমরা সায় দিলাম, তিনি সত্যি অসামান্য সুন্দরী ছিলেন।
‘নিশ্চয়ই, যে তাকে দেখত সেই মুগ্ধ হতো।’ পোস্টমাস্টার স্লাদকোপেজভ বলতে লাগলেন, ‘কিন্তু জেনে রাখো, আমি আমার স্ত্রীকে তার সৌন্দর্য কিংবা নম্র মেজাজের জন্য ভালোবাসতাম না। এমন গুণ জগতের অনেক স্ত্রীলোকের মধ্যেই আছে। আমি তাকে ভালোবাসতাম কারণ সে ছিল স্বামীর প্রতি একান্ত বিশ্বাসিনী। সে আমাকে কখনো অবহেলা করেনি, যদিও তার বয়স মাত্র কুড়ির বেশি নয়, আর আমি ষাট বছর অতিক্রম করতে চলেছি।’
আমাদের মধ্যে সেক্সটোনের খুকখুক কাশি শোনা গেল।
অমনি বৃদ্ধ বললেন, ‘কী, আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না?’
‘না, ঠিক তা নয়’ সেক্সটোন এবার আমতা আমতা করে বলল, ‘তবে কিনা মানে-মানে-আজকালকার তরুণী বউরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ওই যাকে বলে সুপুরুষের প্রতি-মানে স্বামীকে ধোঁকা দিয়ে।’
-বুঝেছি, তুমি সন্দেহ করছ? বেশ, তাহলে খুলেই বলি-বুড়ো বিপত্নীক বলতে শুরু করলেন-আমি আমার স্ত্রীর বিশ্বস্ততা বজায় রাখার জন্য কিছু কৌশল ও পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলাম। আমার এই কৌশল, যা খুবই শিল্পসম্মত বলা যায়, তা আমার স্ত্রীকে আমার প্রতি বিশ্বস্ত না রেখে পারেনি। আমার এই কৌশলই আমার দাম্পত্য জীবনকে নিরাপত্তা দিয়েছে, আর এর মূলে ছিল আমার স্ত্রীর সম্পর্কে আমারই বানানো কিছু রটনা।
-কী রটনা?
-তোমরাও তা জানো। এই শহরের মধ্যে আমি নিজেই আমার স্ত্রী সম্পর্কে কুৎসা রটিয়ে দিলাম যে আমার স্ত্রী ইয়েলেনা এই শহরের পুলিশপ্রধান আলেক্সেই স্যালিক্ভাস্কির সঙ্গে প্রণয়সূত্রে বাঁধা। এই একটি রটনাই যথেষ্ট ছিল। একজন লোকেরও সাহস হয়নি ইয়েলেনার প্রেমে পড়ে পুলিশপ্রধানের বিরাগভাজন হতে। অবস্থা এমনই ছিল, ইয়েলেনা নিজেও যদি কারোর দিকে চোখ তুলে তাকাত, সেই লোক তৎক্ষণাৎ পালিয়ে যেত সামনে থেকে, কে জানে পুলিশপ্রধান যদি জানতে পারে, এই ভয়ে।
বলতে বলতে হাসতে লাগলেন বৃদ্ধ বিপত্নীক। হাসতে হাসতেই বললেন, আর পুলিশ-প্রধানের পেছনে লাগার মজা কে না জানে!
এবার বি্নিত কণ্ঠে বললাম, ‘তাহলে এত দিন যে শোনা যেত আপনার স্ত্রীর আলেক্সেই স্যালিক্ভাস্কির সঙ্গে প্রেম আছে, তা সত্যি নয়?’
‘মোটেই নয়। তোমাদের ওই জানানোটাই তো আমার কৌশল।’ হাসতে হাসতে বললেন বৃদ্ধ বিপত্নীক স্ল্যাদকোপেজভ। ‘এভাবেই আমার তরুণী স্ত্রীর কাছ থেকে তোমাদের মতো ছোকরাদের ঠেকিয়ে রেখেছিলাম, এত দিনে সেটা জানলে তোমরা।’
মিনিট তিনেক আমরা হতভম্ব হয়ে রইলাম। ক্রমে ক্রমে অসহ্য অপমান আমাদের গ্রাস করতে লাগল। সামনে বসা ওই মোটা নাকওয়ালা বুড়োটা এত দিন আমাদের কী ঠকানোটাই না ঠকিয়েছে।
‘ভগবান তোমার আর একটা বিয়ে করার মতি দিন।’ সেক্সটোনের অস্কুট স্বর শোনা গেল।
অনুবাদঃ স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়
আন্তন চেখভঃ রাশিয়ান ছোট গল্পকার ও নাট্যকার। জন্ম-২৯ জানুয়ারি ১৮৬০, মৃত্যু-১৫ জুলাই ১৯০৪
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১৬, ২০০৯
Leave a Reply