জোকস সম্পর্কে রস+আলোতে লিখতে গিয়ে প্রথমেই মনে পড়ে যায় আমাদের দেশের জোঁক সম্পর্কিত সেই অতি প্রাচীন মুখরোচক গল্পটিঃ মধ্যবয়সী বিলেতি মেমসাহেব বেড়াতে এসে বর্ষাকালে বন্যাপ্লাবিত গাঁয়ের রাস্তা দিয়ে খালি পায়ে হাঁটছিলেন। ডাঙায় উঠে তিনি দেখতে পেলেন তাঁর এক পায়ে কালো পিচ্ছিল এক প্রাণী মাংসপেশির সঙ্গে লেপ্টে আছে। মেমসাহেব ভীত-বিহ্বল হয়ে কাছেই উপবিষ্ট গাঁয়ের এক লোককে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হোয়াই ইজ ইট’, মানে এটা কী? লোকটি সামান্য ইংরেজি জানত, কিন্তু জোঁকের ইংরেজি যে লিচ এটা সে জানত না। তাই সে বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে জবাব দিল, ‘ইট ইজ জোঁক’।
মেমসাহেব আর্তচিৎকার করে উঠলেন, ‘হাফ এন ইঞ্চ ইনসাইড মাই বডি, অ্যান্ড স্টিল ইটস এ জোক!’ অর্থাৎ ‘আমার শরীরের ভেতরে আধা ইঞ্চির মতো ঢুকে গেছে, আর তুমি বলছ এটা হাসি-ঠাট্টা!’
সে যা হোক, প্রসঙ্গত আরেকটি গল্প মনে পড়ে গেলঃ অফিসের মাঝারি পর্যায়ের এক কর্মকর্তা দুপুরে তাঁর অধস্তন কর্মচারীদের নিয়ে একসঙ্গে চা-নাশতা খেতেন আর জোকস তথা হাসির গল্প বলে সবাইকে হাসাতেন। তো একদিন যখন তিনি এভাবে জোকস বলছিলেন, তখন লক্ষ করলেন সবাই হাসছে বটে, কিন্তু একজন অর্থাৎ ভূপতিবাবু একেবারে চুপচাপ। তিনি ভূপতিবাবুকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘আপনি আজ হাসছেন না কেন? আপনার কি মন খারাপ?’ ভূপতিবাবু সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন, ‘যারা হাসার তারা তো ঠিকই হাসছে। আমি হাসব কেন? আমি তো আর আপনার আন্ডারে চাকরি করছি না, গতকাল থেকে অন্য সেকশনে বদলি হয়ে গেছি।’
প্রসঙ্গত, জোকস-সংক্রান্ত সেই জাপানি গল্পটিও স্মর্তব্যঃ জাপানিরা খুব ভদ্র জাতি, ওরা পারতে কাউকে অখুশি করতে চায় না। একবার এক মার্কিন জেনারেল জাপানের সেনাছাউনি পরিদর্শনে গেলেন, সঙ্গে জাপানি দোভাষী। দোভাষীকে তিনি বললেন, ‘আমি উপস্থিত সেনাসদস্যদের একটি জোকস শোনাব। কিন্তু ওরা তো ইংরেজি বুঝবে না, আপনি সেটা তর্জমা করে দেবেন, দেখবেন ওরা হাসিতে লুটিয়ে পড়বে।’ অতঃপর তিনি প্রায় দুই মিনিট ইংরেজিতে একটি লম্বা জোকস বলে দোভাষীকে সেটা তর্জমা করতে ইশারা করলেন। দোভাষী জাপানি ভাষায় ছোট্ট একটি বাক্য বলার পরপরই সব সেনাসদস্য হাসিতে ফেটে পড়ল। জেনারেল অবাক হয়ে এটার কারণ জিজ্ঞেস করলে প্রথমে দোভাষী কিছুই বলতে রাজি হলো না। পরে পীড়াপীড়ি করায় থলের বিড়াল বেরিয়ে এল।
‘আপনার জোকসটিতে আমি হাসির কিছুই খুঁজে পাইনি।’ দোভাষী বলতে লাগল, ‘কিন্তু আপনি আমাদের সম্মানিত মেহমান। আপনাকে তো আর অসন্তুষ্ট করা যায় না। তাই আমি সেনাদের বলেছি-জেনারেল সাহেব এই মাত্র একটি জোকস বলেছেন, আপনারা সবাই হাসুন। আর তাতেই কাজ হয়েছে।’
তবে হ্যাঁ, আনাড়িদের হাতে পড়লে কিন্তু জোকের বারোটা বেজে যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে তেমনি একটা জোকস বলা যায়ঃ জাহাজের যাত্রীরা উৎসাহ নিয়ে জাহাজের ডেকে ভিড় করেছে। ভিড়ের মধ্য থেকে হঠাৎ একটি ছোট্ট বাচ্চা পানিতে পড়ে গেল। উপস্থিত সবাই ধরো ধরো বললেও কেউই এগিয়ে এল না। হঠাৎ দেখা গেল এক বুড়ো যাত্রী পানিতে পড়ে বাচ্চাটিকে আঁকড়ে ধরে ভেসে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। জাহাজ থেকে রশির মই ফেলে দুজনকেই উদ্ধার করা হলো। এই ঘটনায় সবাই বুড়োর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বলল, ‘এখনকার যুগে এরূপ পরহিতৈষী লোক বিরল।’ সব শুনে বুড়ো চারদিক ভালো করে পর্যবেক্ষণের পর বলে উঠলেন, ‘সবই তো বুঝলাম। কিন্তু আমি জানতে চাই, আমারে ধাক্কাটা দিছিল কেডা?’
আমার এক সাবেক সহকর্মী একবার এই গল্পটা আমাকে বলতে গিয়ে মধ্যক্ষণে বলে বসলেন, ‘সবাই বলছেন ধরো ধরো, কিন্তু কেউই এগিয়ে আসছে না। হঠাৎ এক বুড়োকে একজন ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিল···।’ আমি তখন তাঁকে সহাস্যে বললাম, “আপনার হাতে পড়ে জোকসটি মাঠে মারা গেল। প্রতিটি জোকসের একটি করে ‘পাঞ্চলাইন’ থাকে, যেটা সবশেষে বলতে হয়, এটা প্রথমেই বলে দিলে জোকস আর জোকস থাকে না।”
আর হ্যাঁ, একটি জোকসের সফলতা যতটা না নির্ভর করে কথকের ওপর, তার চেয়ে অনেক বেশি নির্ভর করে শ্রোতার ‘রিসিভার’ তথা ‘অ্যান্টেনা’র ওপর। আমি দেখেছিঃ আমার বিবেচনায় খুব মজার একটি জোকস বলেছি; অথচ শ্রোতাবিশেষ কিংবা শ্রোতাদের কাছে ওটা হালে পানি পায়নি। আবার অতি সাধারণ জোকস ব্যক্তিবিশেষের কাছে খুব ভালো লেগেছে। এটিকে ইংরেজিতে ‘ক্লিক’ করা বলে। রস+আলোর পাঠক, জোকস বলার সময় পাঞ্চলাইন আর কখন কোন জোকস বললে সেটা ‘ক্লিক’ করবে সেদিকে বিশেষ নজর দিন, না হয়জোকটি হাটে-ঘাটে-মাঠে মারা পড়বে এবং এর দায়ভার কেউই নিতে রাজি হবে না।
আতাউর রহমান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ১৬, ২০০৯
Leave a Reply