পরিবারটা ছোট্ট, কিন্তু দিলটা বড়-মেহমান ছাড়া কোনো দিন খেতে বসে না। সারা দিনের কাজবাজ সেরে প্রতিদিন বিকেলে ওদের বাবা বেরিয়ে যান নদীর ঘাটে মেহমানের খোঁজে।
বাগদাদের পশ্চিমে দজলা নদী। কত জাহাজ আসে। কত জাহাজ যায়। ওদের বাবা দাঁড়িয়ে থাকেন-যদি বা জাহাজযাত্রী এই বিদেশি সওদাগরদের কেউ দয়া করে তাঁর মেহমান হয়ে যায়।
সেদিন কোনোমতেই মেহমান পাওয়া যাচ্ছিল না। একজন যাত্রী আসে তো দশজনে টানাটানি।
শেষে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর, অনেক রাতে, একজন মেহমান পদধূলি দিলেন। সেও কত কন্ডিশনে, ‘বেশি খাওয়াবেন না তো?’ ‘না। শুধু সাদা পোলাও। সাদা কোরমা।’ ‘এক বেলার বেশি নয় তো?’ ‘স্রেফ এক বেলা।’ ‘আমিরি অভ্যর্থনা?’ ‘না না। ওসব কিচ্ছু না-আসুন।’
এতগুলো কন্ডিশনে তবে মেহমান ভয়ে ভয়ে রাজি হন এবং গুটি গুটি পায়ে রওনা হলেন।
মেহমান এসেছেন। মেহমান এসেছেন। তাঁবুর ঘর, সেই ছোট্ট পরিবারটিতে মৃদু একটা আনন্দের গুঞ্জন ওঠে। দুম দুম করে তাঁবুর দরজা খুলে যায়। শিগগিরই পরিবারের ছেলেমেয়েগুলোর জটলা বসে গেল। কত গল্প করেন তিনি। গল্পে গল্পে একসময় খাবারের সময় আসে।
ওই তো একখানা গোলটেবিলের চারধারে চেয়ার পেতে ওরা বসে গেল খেতে। বাপ-মা, দুটো ছেলে, দুটো মেয়ে, আর মেহমান-মোট সাতজন।
প্রথম কিস্তিতে এল ঘিয়ে ভাজা আস্ত পাঁচটা কবুতর। এতক্ষণ গল্প শোনার পর ছেলেমেয়েদের জবর খিদে পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মেহমান না দিলে তো আর ওরা নিতে পারে না। ও দেশের নিয়ম হলো, মেহমানই পরিবেশন করবেন।
এদিকে মানুষ সাতজন, অথচ কবুতর পাঁচটা। মেহমান পড়লেন মুশকিলে। মনে মনে কী ভেবে মেহমান বাপ-মাকে একটা কবুতর, ছেলে দুটোকে একটা কবুতর, আর মেয়ে দুটোকে একটা কবুতর দিয়ে, নিজের পাতে নিয়ে বসলেন দুটো কবুতর।
মেহমানের কীর্তিখানা দেখে ছেলেগুলো ‘হাঁ’ করে তাকিয়ে রইল। তাহলে এতক্ষণে মেহমানের স্বরূপখানি পরিষ্কার হয়ে গেল। হ্যাঁ, কথাবার্তায় মিষ্টি বটে; কিন্তু স্বার্থের বেলায় ষোল আনা সজাগ।
তারপর এল দ্বিতীয় দফা। মস্ত বড় একটা তেলতেলে মুরগিকে আস্ত রোস্ট করে একখানা চিনামাটির প্লেটে করে এনে দেওয়া হলো মেহমানের সামনে, তিনি ভাগ করে দেবেন বলে।
এবার ছেলেমেয়েরা তাড়াতাড়ি ছুরি-কাঁটা খুঁজে এনে দিলে, কী জানি দৈবাৎ কেটে ভাগ করে দেওয়ার যন্ত্রপাতির অভাবে যদি মেহমান সবটা মুরগি নিজের পাতেই নিয়ে বসেন। কিন্তু কার্যত মেহমান যা করলেন, সেটা সবটা নেওয়ারই শামিল। করলেন কী মেহমান? শাঁই করে ছুরিখানা দিয়ে কেটে ‘রান’ দুটো ছেলে দুটোকে দিলেন, ডানা দুটো মেয়ে দুটোকে দিলেন, আর গলাটা কেটে মুড়োটা দিলেন মা-বাবাকে! আর বাদবাকি যা রইল সবটা নিয়ে বসলেন নিজের পাতে।
এহেন ভদ্র মেহমানের এতখানি আত্মপক্ষপাতিত্বে ছেলেমেয়েগুলো কেমন যেন পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি শুরু করল। কী নির্লজ্জ মেহমান রে! কোথায় বিনয় করে নিজের পাতে কম কম নেবেন, আর সবাইকে বেশি বেশি করে দেবেন, সে জন্যই তো মেহমান দেওয়ার প্রথা, না, সবকিছুই নিজের পাতে!
পরদিন মেহমান বিদায় নেবেন। একে একে সবাই বিদায় দিলেন। কিন্তু সবচেয়ে ছোট ছেলেটি আমতা আমতা করে শেষে বলেই ফেলল, ‘মেহমান সাহেব, যাওয়ার আগে কিন্তু একটা কথা বলতে হবে। কাল রাতে যে আপনি খাবার ভাগ করলেন, সবকিছুই আপনার পাতে বেশি বেশি করে নিলেন, এটা কি ন্যায় হলো?’
এমন স্পষ্ট আক্রমণে মেহমান কিন্তু কুণ্ঠিত হলেন না। ‘কেন ভাই, আমি তো সাম্য বজায় রেখে সমান ভাগ করে বেঁটেছি বলেই মনে পড়ে। তোমরা তো আমায় পাঁচখানা কবুতর দিয়েই খালাস। এদিকে আমি পড়লুম মুশকিলে-মানুষ সাতজন, কবুতর পাঁচটা। কী করি? হঠাৎ আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসে গেল।
‘করলুম কী আমি? মা-বাবা আর একটা কবুতর এই তিন, ছেলে দুটো আর একটা কবুতর এই তিন, মেয়ে দুটো আর একটা কবুতর এই তিন, আর আমি আর দুটো কবুতর এই তিন। তিন, তিন, তিন, তিন। সবই তিনের ভেতর ফেলে দিলুম, কেমন? সমান ভাগ হয়ে গেল, নয় কি?’
ভাগের হিসাবের কাণ্ডকারখানা দেখে সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
‘বেশ বেশ। তাহলে মুরগির বেলায় সাম্যটা হলো কেমন করে শুনি?’
‘মুরগি? সেটা আমি নিয়েছিলুম আর এক হিসাবে। ততক্ষণে ছুরি-কাঁটাও এসে গেল কিনা। ভাবলুম, ছুরিই যখন এসেছে, তাহলে ভগ্নাংশেই যাওয়া যাক। দেখলুম, মা-বাবা সংসারের কর্তা। তাঁরাই সংসারের মাথা। কাজেই গলাটা ছিঁড়ে মাথাটা দিয়ে দিলুম তাঁদের। তারপর ভাবলুম, মেয়ে দুটো তো দুদিন বাদে বিয়েশাদি হয়ে পরের ঘরেই উড়ে চলে যাবে। কাজেই দিলুম ঠুকে তাদের দুজনাকে দুটো ডানা-উড়ে যেতে সাহায্য করবে বলে। ফের ভাবলুম, মা-বাবাও বুড়ো হয়ে যাবেন, মেয়ে দুটোও চলে যাবে, ছেলে দুটোর ওপরই একদিন না একদিন গোটা সংসারের চাপ পড়বে, যেমন মুরগির সমস্ত শরীরের ওজন পড়ে ওর রান দুটোর ওপর। কাজেই তাদের দিয়ে দিলুম রান দুটো। মুরগির শরীরে আর বাদবাকি যা থাকে, তাকে দেখতে অনেকটা জাহাজের মতো দেখায় না কি?’ ‘হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে।’
‘এখন, আমি এসেছিলুম একখানা জাহাজে করে। কাজেই ভাবলুম, ওটা আমারই প্রাপ্য।’ এ পর্যন্ত বলে মেহমান বললেন, ‘আচ্ছা, ভাই, আজ তবে আসি।’ বলেই তাঁর লম্বা পাগড়ি আর জোব্বাজাব্বাগুলো তুলে নিয়ে গুটি গুটি পায় তিনি বেরিয়ে পড়লেন তাঁর নিরুদ্দেশ যাত্রায়। (ঈষৎ সংক্ষেপিত ও সম্পাদিত)
সাজেদুল করিম, শিশুসাহিত্যিক।
পেশাগত জীবনে অর্থনীতির শিক্ষক। জন্ম-১৯১৫,মৃত্যু-১৯৯৪।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মার্চ ০২, ২০০৯
Leave a Reply