আপনার নামের সার্থকতা কোথায়?
* শুরুতেই বলি, আমার নামটা আমার নিজের রাখা লেখক-নাম (পেন নেম) নয়। ওটা আমার পিতৃদত্ত নাম। আমার ইমিডিয়েট বড় এক ভাই ছিলেন। বাবা তাঁর নাম রেখেছিলেন কালিদাস। কালিদাস মাত্র তিন বছর বয়সে মারা যান। ফলে আমার পিতার স্বপ্ন পূরণ করে মহাকবি কালিদাসের যথাসম্ভব মানরক্ষার দায় বর্তায় আমার ওপর। সেই দায় অত্যন্ত অপাত্রে বর্তেছে বলেই সংশ্লিষ্ট সবার মতো আমিও বিশ্বাস করি। আমার পিতৃদত্ত নাম নির্মল (পরিষ্কার)+ইন্দু (চন্দ্র/চাঁদ)+গুণ। শাহবাগের রেডিও বাংলাদেশের প্রবেশপথে দায়িত্বপালনরত একজন সদ্য রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারী জোয়ান (১৯৭৫) আমার নাম লিখেছিলেন-নির্মল হিন্দু গুণ। এন্ট্রি বুকে আমার নাম লিপিবদ্ধ করার আগে নিজের নাম শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করতে না পারার জন্য সেদিন তিনি আমাকে মৃদু ভর্ৎসনাও করেছিলেন। এখন যদি আমাকে আমার নাম নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে আমি আমার নাম রাখব-অনির্মলচন্দ্র দোষ।
আপনি কবি না হলে কী হতেন?
* এটি একটি অত্যন্ত উদ্ভট প্রশ্ন! মানুষের এখতিয়ার-বহির্ভূতও বটে। কবির পক্ষে কবি না হওয়ার কোনো উপায় থাকে না। কবিরা জন্মসূত্রেই কবি।
আপনি লজ্জা পান কখন?
* আমি লজ্জা পাই দিনের বেলায়। তবে চারপাশে নির্লজ্জদের অবাধ বিচরণ দেখে দেখে আজকাল আর দিনের বেলাতেও খুব একটা লজ্জা পাই না। শাস্ত্র বলে, লজ্জা হচ্ছে নারীর ভূষণ। তাহা নরগণের বেলায় প্রযোজ্য নহে। নির্লজ্জদের হাসতে দেখে আমি রাতের বেলাতেও লজ্জা পাই।
বর্তমান যুগের কোন বিষয়টি আপনার খারাপ লাগে?
* আগে ভিক্ষা করত কেবল ভিখিরিরা, এখন শিক্ষিত ভদ্রলোকেরাও ভিক্ষা করেন। তবে বৈচিত্র্য এসেছে ভিক্ষার ধরনের মধ্যে। অনেক সময় বোঝা যায় না।
আপনাকে যেকোনো একটি কবিতার প্যারোডি করতে বলা হলে আপনি কোন কবিতাটির প্যারোডি করবেন?
* ঠিক প্যারোডি নয়। একটি বিখ্যাত কবিতার নবমূল্যায়ন করব। কবিতার নাম সোনার তরী। কবির নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এত কবিতা থাকতে ওই বিখ্যাত কবিতাটি কেন? আমার সদ্য প্রকাশিত এবং প্যারিস গ্রন্থে আমি তার কারণ ব্যাখ্যা করেছি।
পলাশী যুদ্ধে জয়লাভের পর ক্লাইভ যখন মুর্শিদাবাদ সফরে যান, তখন মীর জাফর তাঁকে খুশি করার জন্য ৭৫টি নৌকা বোঝাই করে বাংলার ধনসম্পদ উপঢৌকন হিসেবে দিয়েছিলেন বা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। স্বর্ণ, রৌপ্য, হীরা-জহরত এবং অন্যান্য ধাতব মুদ্রা দিয়ে ৭৫টি নৌকা বোঝাই করে কলকাতার পথে রওনা হন রবার্ট ক্লাইভ। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে অপস্রিয়মাণ ক্লাইভের নৌবহরের দিকে তাকিয়ে মীর জাফর তখন কী ভাবছিলেন, তা ইতিহাসে পাওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী কবিতায় কিছু পাওয়া যায়।
‘···যত আছে তত লও তরণী পরে।/আর আছে? আর নাই দিয়েছি ভরে,/
এবার আমারে লহ করুণা করে।
····
শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি-,/যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।’
ক্লাইভের জীবনী পাঠ করতে গিয়ে আমি যখন ক্লাইভের মুর্শিদাবাদ লুণ্ঠনের এই ভয়াবহ ঘটনাটির সঙ্গে পরিচিত হই, তখন রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ কবিতার এই নতুন ব্যখ্যাটি আমার মনে আসে।
অভিনয় করতে বলা হলে আপনি কোন চরিত্র বেছে নেবেন?
* রবীন্দ্রনাথ। সাদা চুল-দাড়িতে আমাকে ওই চরিত্রে মানাবে বলেই মনে হয়। সত্যি সত্যি তো আর আমি তাঁর চরিত্রে অভিনয় করছি না। শুনেছি, স্বপ্নের ভেতরে বুদ্ধিমানেরা ভাতের বদলে বিরিয়ানি খেতেই বেশি পছন্দ করেন।
কখন নিজেকে অসহায় লাগে?
* ‘মরে যাব’ এই কথা জেনে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে না কোনো শিশু। পরে ক্রমশ সে ভয়াবহ মৃত্যুর সঙ্গে পরিচিত হয়। তখন থেকে তার মধ্যে মৃত্যুর বোধ ও ভীতি জন্ম নেয়। মনুষ্যজীবনের সবচেয়ে বড় অসহায়ত্বটা সেখানেই। আমিও এর ব্যতিক্রম নই।
কোন বস্তু হারিয়ে গেলে আপনার একটুও কষ্ট হবে না?
* ক্ষয়ে যাওয়া নড়বড়ে কোনো দাঁত।
ঘুম না এলে কী করতে ভালো লাগে?
* দেখতে। লিখতে। পড়তে। ভাবতে।
কী খেতে আপনার মোটেও ভালো লাগে না?
* ছ্যাঁকা এবং বিষ।
বাংলাদেশ ছেড়ে কোথাও চলে যেতে হলে কোথায় যাবেন?
* তেমন প্রয়োজন হবে না বলেই আমার আশা। তারপরও যদি হয়, তবে সম্ভবত আমি যাব টোকিও অথবা প্যারিস।
সাক্ষাৎকার গ্রহণঃ জিনাত রিপা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ২৩, ২০০৯
Leave a Reply