আমার এক বন্ধু আছে (বন্ধু বলব, না শত্রু বলব, ঠিক বুঝতে পারছি না)। তার ধারণা, এই জাতি বই পড়ে পড়ে উচ্ছন্নে যাচ্ছে! বই পড়ে এই জাতির ব্রেন (তার ভাষায় ঘিলু) নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বা গেছে। বই পড়া বাদ দিয়ে বরং বাথরুমে আছাড় খেয়ে পড়া ভালো···এতে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মাথার ঘিলু নাকি নড়ে ওঠে এবং নতুন করে কাজ করতে শুরু করে। এই বন্ধুর বাসায় একবার বহু আগে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি, তার বাসায় কুল্লে নটা বই! তার মধ্যে একটা হচ্ছে টেলিফোন ডাইরেক্টরি, বাকি আটটা তার এইটে পড়ুয়া পুত্রের পাঠ্যবই! তো সেই বন্ধু হঠাৎ ঘোষণা দিল, সে বইমেলায় যাবে এবং আমার বই কিনবে (বলাই বাহুল্য, সে তার সুদীর্ঘ জীবনে একবারও বইমেলায় আসেনি)!
-এবার হঠাৎ বইমেলায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলি? আমি প্রশ্ন না করে পারি না।
-কাগজে দেখলাম, তোর বই বেরিয়েছে।
-তো?
-তাই ভাবলাম, তুই যদি লেখক হতে পারিস, আমিও বইমেলায় যেতে পারি।
যাই হোক, সে সত্যি সত্যিই একদিন পুত্রের হাত ধরে বইমেলায় এসে হাজির।
-তোর কটা বই বেরিয়েছে?
-বেরিয়েছে কয়েকটা।
-আরে বাবা, বল না কটা! তোর সব বই কেনার তৌফিক আল্লাহ তায়ালা আমাকে দিয়েছেন। তখন আমাকে পরিষ্কার গলায় বলতে হলো, ‘বারোটা-এক ডজন’ (পাঠক আবার ভাববেন না···এই চান্সে আমি রস+আলোতে বইয়ের বিজ্ঞাপন শুরু করেছি)।
-বারোঅঅঅটা···বন্ধুর মনে হলো বুকে হাত দিয়ে বসে পড়ার অবস্থা! তারপর চিকন গলায় চিঁ চিঁ করে বলল, ‘বারোটাই কিনতে হবে?’ আমি বললাম, না, কোনোটাই কিনতে হবে না। আমার বই কেনে পাঠকেরা, আর তুই তো পাঠক না।
-আমি কী?
-তুই পাঠক না···শুধু ঠক।
-আমি ঠক??
-হ্যাঁ, কারণ তোর বাসায় কোনো বই নেই। তুই বই না পড়ে নিজেকে ঠকাচ্ছিস, তোর ছেলেকে ঠকাচ্ছিস···তোর বউকেও ঠকাচ্ছিস···।
-এই কথা তু-তুই বলতে পারলি?
আমার বন্ধু মনে হলো বজ্রাহত হলো, যাকে বলে বিনা মেঘে বজ্রপাতিত। তাকে আমার দুইটা বই গিফট করলাম···একটা সে বহু কষ্টে কিনল (এখন তার বাসায় বইয়ের সংখ্যা হলো এক ডজন!)।
এবারের বইমেলায় বিদেশ থেকে অনেকে এসেছেন। তাঁরা মেলা উপলক্ষেই আসেন, সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে। এমন একজনের সঙ্গে পরিচয় হলো, যিনি ১১ বছর পর দেশে এসেছেন এবং তিনি হতাশ! তিনি এ দেশে এসে আবিষ্কার করেছেন, এ দেশে কেউ ‘সরি’ আর ‘প্লিজ’ শব্দ দুটি বলে না···এবং যে কারণে এ দেশের উন্নতি হচ্ছে না বা হবে না। তাঁকে বলতে পারলাম না, ওই শব্দ দুটি বিদেশে চট করে বলে, কারণ শব্দ দুটি ছোট আর তারা (বিদেশিরা) শব্দ দুটি আসলে ভেতর থেকে বলে না, অভ্যাসবশত বলে···সে তুলনায় এর বাংলা দুঃখিত আর অনুগ্রহপূর্বক বেশ বড়। কাজেই সব সময় আমাদের (বাংলাদেশিদের) পক্ষে বলা হয় না বা বলে না। তা ছাড়া এমনিতেই আমরা অনেক দুঃখের মধ্যে আছি। আবার ঘন ঘন মুখে ‘দুঃখিত’ বলে বলে মুখে ফেনা ওঠানোর কোনো মানে দেখি না। আর আমরা বাঙালিরা খারাপ-ভালো যা-ই বলি, সরাসরি ভেতর থেকেই বলে ফেলি, ভান করি না।
এক তরুণ লেখকের সঙ্গে পরিচয় হলো, যার প্রথম বই মেলায় আসছে। সে খুবই উত্তেজিত। অলরেডি তিনটি জাতীয় দৈনিকে তার বইয়ের (প্রচ্ছদসহ) রিভিউ বের হয়ে গেছে! কিন্তু বইয়ের খবর নেই! সে খুবই টেনশনে আছে। কারণ প্রকাশক নাকি ধরা দিচ্ছে না। যখনই বইয়ের প্রসঙ্গ আসে, সে বাইন মাছের মতো পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে। ‘আহসান ভাই, আমি এখন কী করি বলেন তো? প্রকাশক তো ধরা দিচ্ছে না···বারবার পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে!’
-ছাই দিয়ে ধরো। আমি বুদ্ধি দিই।
-ছাই পাব কোথায়? ঢাকা শহরে ছাই আছে নাকি?
-আছে আছে···মেলায় অনেক ছাইপাস বই (আমারগুলোসহ) বের হয়, ওখান থেকে ছাই জোগাড় করো।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ২৩, ২০০৯
Leave a Reply