এক ডিসেম্বরে আমার এক বন্ধু বিনা মেঘে ছ্যাঁকা খেয়ে বসল। বিচ্ছেদের স্বাভাবিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তিনটি-কেউ দেবদাস হয়, কেউ কবিতা লিখতে শুরু করে, ধুরন্ধরেরা নতুন প্রেমিকা খোঁজে। আমার বন্ধুর ক্ষেত্রে তিনটি প্রতিক্রিয়া নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্র মেনে সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় এক ভজঘট পাকিয়ে ফেলেছিল।
যার ফলে আমরা খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, অবাধ্য-অবিন্যস্ত চুল-গোঁফের রুখু রুখু চেহারার এক দেবদাস; দিনমান কবিতা লেখায় ব্যস্ত এক কবি এবং তাঁর নিজের ভাষায়, ‘কাব্যের সঙ্গে প্রেমে মত্ত এক প্রেমিক’-এর খোঁজ পেলাম! পুরো ডিসেম্বরে সেই বন্ধু, ধরা যাক তাঁর নাম দেবা (এটা দেবদাসের সংক্ষিপ্ত রূপ, ‘মুখোপাধ্যায়’ পদবিধারী কারও সঙ্গে মিলে গেলে তা কাকতালমাত্র), প্রায় শ পাঁচেক কবিতা লিখে ফেলল!
তা লিখুক। আমাদের আপত্তি নেই। কাব্যপ্রতিভায় বাধা দেওয়ার মতো বেরসিক আমরা নই। কিন্তু সমস্যা হলো, তাঁর লেখা ‘অশেষ পঙ্কের/ পঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে কাল মহাকাল/ ভ্রষ্ট জাঁতাকলে ত্রস্ত বামাল/ শব্দহীন কানে দূষিত বাতাস/ আর পাংচারায়িত টায়ার’ টাইপের কবিতা পড়ে ইতিমধ্যে কেউ কেউ কয়েকটা দাঁত হারাল। শুনতে গিয়ে শ্রবণ-প্রতিবন্ধী হয়ে গেল কেউ কেউ!
কবি থেকে কয়েক ধাপ পদোন্নতি পেয়ে যখন সে কবিরাজের দিকে এগোচ্ছিল, আমাদের অবস্থা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। অবশেষে কেউ একজন বুদ্ধিটা দিল, যাকে বলে অমোঘ দাওয়াই। দেবাকে বলল, ‘সামনেই তো বইমেলা। বন্ধু, তুমি পুস্তক বাহির করিয়া ফেল। তোমার কাব্যরস যেভাবে উছলিয়া পড়িতেছে, তাহাতে বইমেলার শুষ্ক ধুলো-প্রাঙ্গণ প্রাণ ফিরিয়া পাইবে।’
প্রস্তাবটা তাঁর মনে ধরল। বইমেলায় নিজের পকেটের টাকা খরচ করে, কোনো এক ‘ছাদ আছে ঘর নাই’ প্রকাশনী থেকে বের হয়েছিল তাঁর বই। প্রথম এডিশনে প্রকাশক বলেছিলেন, বের হবে ২০০ কপি। কিন্তু ২০টার বেশি বই কখনোই স্টলে হাজির হয়নি। প্রয়োজনও পড়েনি। কারণ, বইমেলা শেষে ওই ২০ কপির ১৯টাই ফেরত গেছে। একটা কপি কে কিনল সেটা আজও আমাদের কাছে অমীমাংসিত এক রহস্য। স্টলের ছেলেটা জানিয়েছিল, কোনো এক বোরকা আচ্ছাদিতা নাকি কিনে নিয়ে গেছে তালগাছের একটা পা, গরুর আছে চারটা নামের সেই কাব্যগ্রন্থ। দেবার দাবি, ওই মেয়ে তাঁর হারানো প্রেমিকা। আমাদের সন্দেহ, সেটা দেবা নিজেই!
এর পর কী হলো সংক্ষেপে বলিঃ সেই বইমেলা শেষে বন্ধুর মাথা থেকে কবিতার ভূত পুরোপুরি নেমে গেছে। ক্লিনশেভড করে এখন সে ধোপদুরস্ত বাবু। পায়ে ঝা-চকচকে জুতো। টয়লেটে গেলেও ‘ইন’ করে যায়! পরে মার্কেটিংয়ে এমবিএও করেছে এবং এখনো লিখছে। না, কবিতা নয়, লিখছে মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি (বিপণন কৌশল) নিয়ে। এবার মেলায়ও ওর গবেষণাধর্মী একটি গ্রন্থ আসছেঃ আছে বই, কিন্তু পাঠক কই?
সেদিন আজিজ মার্কেটের নিচে দেখা হতেই ও হাসিমুখে আমাকে জানাল বইটার কথা। দুই কাপ গরম চায়ের লোভে চিরকালের ছাপোষা বাঙালি এই আমি হাসিমুখে তার বইয়ের আইডিয়া হজম করে গেলাম।
‘বুঝলি, এই বইটার বিশেষত্ব হলো, এই বই দিয়ে শুধু বই বিক্রি বাড়ানোর কৌশলই বাতলানো হবে না, ওই একই কৌশল এই বইয়ের মার্কেটিংয়েও ব্যবহার করব।’ ‘কী রকম?’ আমার কৃত্রিম কৌতূহল। ‘২৫ জনের একটা দল থাকবে। ওরা আবার পাঁচজন করে ভাগ হয়ে পাঁচটি উপদল হয়ে যাবে। পাঁচটি দল থাকবে পাঁচটি জায়গায়। কেউ লাইনে, কেউ গেটের পাশে, কেউ বিভিন্ন স্টলে। এরা দর্শকদের শুনিয়ে শুনিয়ে নিজেদের মধ্যে গল্প করবে। ধর, লাইনের দলটা নিজেদের মধ্যে আলাপ করবে। একজন উচ্ছ্বাস নিয়ে আরেকজনকে জিজ্ঞেস করবে, ‘এবার গোবিন্দ ধরের বান্দরবানে বাঁদরামি উপন্যাস পড়েছিস? দারুণ না!’
একবার চিন্তা করে দেখ। মেলায় লাইন থেকে ঢোকার মুখে কেউ যদি তিনবার এই কথা শোনে, তার মগজে শুধু একটাই কথা ঘুরবে, বান্দরবানে বাঁদরামি, বান্দরবানে বাঁদরামি···। এইটাই আমার প্রথম কৌশল। আর দ্বিতীয় কৌশল হলো, ওই দলটাই পরে ঘুরেফিরে নামকরা প্রকাশকদের স্টলে স্টলে ঘুরবে। আর গিয়ে জিজ্ঞেস করবে, ভাই বান্দরবানে বাঁদরামি বইটা আছে? চিন্তা করে দেখ, দিনে যদি ৫০টির মতো লোক এসে ওই একটা বই চায়, ওই প্রকাশক নিজেরা গোবিন্দ ধরকে ধরে পরেরবার নির্ঘাত পাঁচটা বই বের করবে।
এরই মধ্যে শুনলাম, ওর ভাড়াটে ভক্ত ২৫ জনের ২০ জনই নাকি প্রথম দিনের পেমেন্ট নিয়েই ভেগেছে। খুব আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করছি, এবার বইমেলা শেষে দেবা না আবার কবি হয়ে যায়!
রাজীব হাসান
সূত্রঃ প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ১৬, ২০০৯
Leave a Reply