পড়ালেখা বাদ দিয়ে কমলকে টিভিতে মি· বিন দেখতে দেখে ভীষণ মেজাজ খারাপ হলো সজলের। পেছন থেকে তার মাথায় একটা চাটি মেরে সজল বলল, ‘কিরে, পড়ালেখা নাই?’
মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কমল বলল, ‘শুধু শুধু মারলে কেন, ভাইয়া? ইংরেজি শেখার জন্যই তো মি· বিন দেখছি।’
‘আমার সাথে একদম চালাকি করবি না। ইংরেজি শেখার জন্য মি· বিন ! আরে মি· বিন-এ তো কোনো সংলাপই নেই, তুই ইংলিশ কী শিখবি?’
কমল ওর খালাতো ভাই। ওর চেয়ে ছয় মাসের বড়। ইদানীং ইংরেজি শেখার ভূত চেপেছে মাথায়। ওর জন্যই তো মি· বিনটা দেখা হলো না।
সব চ্যানেল ঘুরে বিবিসিতে এসে স্থির হলো কমল। খুব মনোযোগ দিয়ে খবর শুনছে। ভাবটা এমন যেন সব বোঝে, আসলে কিছুই বোঝে না। খবর শুনতে শুনতে কমল বলল, ‘এই সজল, যা, কালুকে ডেকে আন।’
সজল উঠল। কালু ওদের বাড়িতেই কাজ করে। তবে কাজের চেয়ে অকাজই করে বেশি। প্রায়ই সে দোকান থেকে টুথপেস্টের বদলে রং ফর্সা করার ক্রিম নিয়ে আসে। সজলের ডাকে কালু আসতেই কমল বলল, ‘কালু, মামুনের হোটেল থেকে ২০টা কিমাপুরি আন তো। কিমাপুরির বদলে ডালপুরি আনলে কিন্তু তোর খবর আছে।’ কালু মাথা নেড়ে চলে গেল। তবে ও যে ডালপুরি, কিমাপুরি কোনোটাই না এনে ২০টা আলুপুরি আনবে, এ বিষয়ে সজল ১০০ ভাগ নিশ্চিত।
রাতে খাওয়ার টেবিলে সজলের বাবা ফরিদ সাহেব বললেন, ‘কমল, তুমি নাকি সারা দিন ইংরেজি সিনেমা দেখ?’
‘জি খালু। আমি স্পোকেন কোর্সেও ভর্তি হয়েছি।’
‘স্পোকেন কোর্স? কী হয় শেখানে?’ ‘ইয়ে··· মানে কথা বলা শেখায়।’ ‘কথা বলা শেখায়? তুমি কি কথা বলতে পার না?’ ‘না মানে ইংরেজিতে কথা বলা শেখায়। কাল থেকেই ক্লাস।’
‘ভালো। তবে এসব কোর্সফোর্স কোনো কাজেরই না, বুঝলে?’
কমল মাথা নাড়ল।
পরদিন সকালে বেশ ফিটফাট হয়ে স্পোকেন কোর্সের প্রথম ক্লাস করতে গেল কমল। জানালার পাশের চেয়ারটাতে বসতেই ‘হ্যালো, ওয়েলকাম, গুডমর্নিং’ বলতে বলতে এক লোক ক্লাসে ঢুকলেন। কমল তাঁকে ছাত্রই ভেবেছিল, কিন্তু পরে বুঝল উনিই টিচার। পরিচয় পর্ব শেষ করেই লোকটা ইংরেজিতে এমন বকবক শুরু করল যে কমল কিছু বুঝতেই পারল না। খুব মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করল সে। হঠাৎ সে খেয়াল করল, লোকটা ‘ক’র জায়গায় ‘খ’ বলছে। ‘স্পোকেন’কে বলছে ‘স্পোখেন’, ‘কনটিনিউ’কে ‘খনটিনিউ’, ‘ক্যাট’কে ‘খ্যাট’, ‘কালেক্টিভ’কে ‘খালেক্টিভ’, ‘কল’কে ‘খল’। কমল বেশ অবাক হলো। সে ভাবল এভাবে ‘ক’র জায়গায় ‘খ’ উচ্চারণ করলেই ইংরেজিতে কথা বলাটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। পুরো ক্লাস করে তার ধারণা আরও পাকাপোক্ত হলো।
ক্লাস শেষে খুশি মনে বেরিয়ে এল কমল। সে এখন ইংরেজিতে মোটামুটি কথা বলতে পারবে এটা ভেবেই আনন্দে মনটা ভরে গেল তার। স্পোকেন কোর্সটার বিজ্ঞাপনে প্রথম দিন থেকেই ইংরেজিতে কথা বলার যে প্রতিশ্রুতি ছিল তা আসলেই সত্যি! বাসায় ফেরার জন্য রিকশা খুঁজতে লাগল কমল। একটা খালি রিকশা পেয়ে বলল, ‘এই খালি, খলাবাগান যাবেন?’ কমলের কথা শুনে অবাক হয়ে গেল রিকশাচালক। ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘উঠেন।’ রিকশাচালক অবাক হওয়ায় আরও খুশি হলো কমল। সে নিশ্চিত যে তার খাঁটি ইংলিশ টান শুনে রিকশাচালক বিভ্রান্ত হয়ে গেছে। কমল ঠিক করল এখন থেকে নিয়মিত ইংরেজিতে কথা বলবে।
বাসায় ফিরেই ভুল-শুদ্ধ মিশিয়ে অনবরত ইংরেজিতে কথা বলতে লাগল সে। কমলের মুখে ইংরেজি কথা শুনে বি্নয়ে সজলের মুখ হাঁ হয়ে গেল। কমল বলল, ‘হেই সজল, হাউ আর ইউ ম্যান? হোয়্যার ইজ মাই আন্টি?’ কোনো কথা না বলে আঙ্গুল তুলে রান্নাঘরের দিকে ইঙ্গিত করল সজল। রান্নাঘরে ঢুকেই কমল তার খালাকে বলল, ‘হেই আন্টি, হাও আর ইউ? হোয়াট ইজ ইউ ডুয়িং?’ ওর কথা শুনে হাসতে হাসতে সজলের মা বললেন, ‘এইসব কী বলছিস উল্টাপাল্টা? যা, ভাগ এখান থেকে।’ কমল বলল, ‘ও নো আন্টি, ইউ নো, প্রথম প্রথম একটু ভুল তো হবেই। এটা কোনো ম্যাটার না। বাট হোয়্যার ইজ খালু?’
‘কেন, তাকে তোর কী দরকার?’
‘ওকে দোকান থেকে খিমাপুরি আনতে পাঠাব। হোয়্যার ইজ হিম···?’ কমলের কথা শেষ হওয়ার আগেই গর্জে উঠলেন সজলের মা। হাতের গোলআলুটা কমলের দিকে ছুড়ে মেরে চেঁচিয়ে বললেন, ‘কী বললি? বেয়াদব কোথাকার! তোর খালুকে তুই কিমাপুরি আনতে দোকানে পাঠাতে চাস! তোর এত বড় সাহস! আজ তোকেই আমি কিমাপুরি বানাব।’ এই বলে তিনি আরেকটা আলু ছুড়ে মারলেন কমলের দিকে। এক দৌড়ে রান্নাঘর থেকে নিজের ঘরে চলে এল কমল। অবস্থা বেগতিক দেখে সজলও এক দৌড়ে ঘরে ঢুকে কমলকে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাইয়া, তুমি কী এমন ইংলিশ বললে যে মা এত রেগে গেল?’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কমল বলল, ‘কী আর বলব, আমি শুধু স্পোকেন স্টাইলে কালুকে খালু বলেছিলাম!’
আদনান মুকিত দীপ্র
সূত্রঃ প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ০২, ২০০৯
Leave a Reply