ভাষার মাস উপলক্ষে রস+আলো এই তো কয়েক দিন আগে রস+আলো উৎপাদন কারখানায় আয়োজন করেছিল এক গোলটেবিল বৈঠকের। আলোচনা অনুষ্ঠান প্রত্যুষে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও গোল একটি টেবিলের অভাব হেতু অনুষ্ঠান কিঞ্চিৎ বিলম্বে শুরু হয়। সেখানে তাঁরা ভাষা নিয়ে বলেছেন অনেক গোপন কথা।
রস+আলো আয়োজিত কাল্পনিক এই গোলটেবিল বৈঠকে যাঁরা অংশ নিয়েছেনঃ
–মাইকেল মধুসূদন দত্ত, মহাকবি
–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বকবি
–বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক
–কায়কোবাদ, মহাকবি
–শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অপরাজেয় কথাশিল্পী
–কাজী নজরুল ইসলাম, বিদ্রোহী কবি
–জীবনানন্দ দাস, প্রকৃতির কবি
–সুকান্ত ভট্টাচার্য, কিশোর কবি
সঞ্চালক : মেহেদী হাসান অপু
রস+আলোঃ আপনারা কষ্ট করে এত দূর এসেছেন। আপনাদের সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।
রবীন্দ্রনাথঃ নিকটে প্রমত্ত পদ্মা না থাকায় যন্ত্রচালিত গাড়িতে আসিতে কষ্ট হইয়াছে। যানজটে পড়িয়া ভীষণ শাস্তি পাইয়াছি।
মধুসূদনঃ কবিগুরু ঠিকই ধরেছেন, ঢাকা শহরে যানজট একটু বেশি। অচিরেই এই যানজট বধ করা হবে, ডিজিটাল সরকারের কাছে এই আশা রাখি।
নজরুলঃ বল বীর, যানজটকে ভেঙে করি পায়েস আর ক্ষীর। আমি বিদ্রোহী রণক্লান্ত, যেদিন ঢাকায় থাকবে না যানজট, আমি সেই দিন হব শান্ত।
সুকান্তঃ কেন পুরাতনদের ফেলে নতুনদের জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে চাই, সেটা স্পষ্ট। পুরাতনরা অহেতুক প্যাঁচাল পেড়ে সময় নষ্ট করেন। তা মশায় বলবেন, আজকের সভার এজেন্ডা কী?
সুকান্তের কথা শেষ হওয়া মাত্র সভায় একটু শোরগোলের সৃষ্টি হলো। রবীন্দ্রনাথ, মধুসূদন, নজরুল-সবাই সুকান্ত অকালে পেকে গেছে বলে ছাড়পত্র দিয়ে শান্ত হলেন।
রস+আলোঃ আসলে আপনাদের কাছে জানতে চাই, আপনারা তো সবাই বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন। যদি বাংলা ভাষার সৃষ্টি না হতো, তাহলে কী করতেন?
রবীন্দ্রনাথঃ কলিকাতা ও কুষ্টিয়ার জমিদারি দেখাশোনা করতুম। যদি জমিদারি না থাকিত, তাহলে সোনার তরীখানি লইয়া পদ্মায় জাল ফেলিয়া মাছ ধরিয়া খাইতাম।
জীবনানন্দঃ তাহলে আমি ডাহুকের ভাষায়, শালিকের ভাষায়, ইঁদুর, প্যাঁচা, হরিণ, কুহুক আর বেলেহাঁসের ভাষায় রূপসী বাংলার সৌন্দর্য বর্ণনা করতাম।
বঙ্কিমচন্দ্রঃ এমন তৃণশরবিদ্ধকর প্রশ্ন শ্রবণে আমার কিঞ্চিৎ জলবিয়োগ সৃষ্টি হইয়াছে। মহাশয়রা আবার ভাবিয়া লইবেন না আমি ডায়াবেটিসের রোগী।
মধুসূদনঃ তার পূর্বে একটি অভিযোগ, একটু আগে সুকান্ত ছোঁকড়া আমাদের অপমানসূচক কথা বলেছে। বাংলা সাহিত্যের এমন অমিতধর কবি-সাহিত্যিকদের খোঁচা মারা হলো অথচ কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলো না, একেই কি বলে সভ্যতা?
নজরুলঃ বাদ দিন মধুবাবু, সুকান্তর এখন ১৮ বছর বয়স, রক্ত গরম। ও তো দেখছি আমার মতোই বিদ্রোহী হবে।
সুকান্তঃ মধুবাবু শুধু শুধু আমাকে অসভ্য বলে গালি দিলেন। অথচ উনি বাঙালি হয়ে ইংলিশ ম্যাম ক্যাপটিভ লেডির পেছনে পেছনে ঘুরেছেন। যেন বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ।
রবীন্দ্রনাথঃ শান্ত হন সবাই, আপনারা একে অপরকে চোখের বালি মনে করিবেন না। মধু ও সুকান্ত, আপনারা দয়া করিয়া ঘরে-বাইরে এমন গোরা আচরণ করিয়া সুন্দর পরিবেশ বিঘ্নিত করিবেন না।
শরৎচন্দ্রঃ বর্মা মুল্লুকে পার্বতীকে লইয়া জলসা দেখিতেছিলাম, সেই ভালো ছিল। শুধু শুধু এখানে এসে সময় নষ্ট করছি।
রস+আলোঃ বাংলা ভাষা এখন ইংরেজি ও বাংলার মিশ্রণে এফএমীয় ভাষায় পরিণত হতে চলেছে। বিষয়টা আপনারা কীভাবে দেখেন?
কায়কোবাদঃ বাংলা ভাষার এমন মিশ্রণে আমি শঙ্কিত। বাংলা ভাষার হাজার বছরের গৌরবের পটভূমিটি মহাশ্মশানে পরিণত হইতে চলিয়াছে।
শরৎচন্দ্রঃ বিষয়টি লইয়া আমি গভীরভাবে ভাবিয়াছি। আমার মেজদিদি একটি এফএম রেডিওর রেডিও জকি। তাঁর কথা শুনিয়া আমার গা জ্বলে। ওকে একটা বাল্যশিক্ষা দিতে হইবে।
বঙ্কিমচন্দ্রঃ জলবিয়োগে কিঞ্চিৎ লেট হইল বলিয়া সরি। কী হে জীবনানন্দ, অমন আধো মুখকালো বিষণ্ন বদনে চাহিয়া কাহারে ভাবিতেছ, সুরঞ্জনাকে?
সুকান্তঃ দেখলেন, বঙ্কিম নিজেই বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলছেন। বাংলা ভাষার কপালে নিশ্চিত তিনি আগুনের কুণ্ডলী ছড়িয়ে দেবেন।
মধুসূদনঃ অনেকক্ষণ আলোচনা করে গলা শুকিয়ে এসেছে। মহাশয়, একটু জলযোগের ব্যবস্থা করবেন। বিদেশি জলের ব্যবস্থা থাকলে ভালো হয়।
রবীন্দ্রনাথঃ যাঁহারা বাংলা ভাষাকে বিকৃত করিতেছেন, তাঁহারা নষ্ট নীড়ের লোক। আমাদের সকলের মনে রাখিতে হইবে, ইংরেজি বলিলে ইংরেজ হওয়া যায়, কিন্তু বাংলা ও ইংরেজি মিশাইয়া বলিলে বাঙালি হওয়া যায় না।
রস+আলোঃ বাংলা ভাষা এখন সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। বাংলা ভাষার এমন গৌরবে আপনাদের প্রতিক্রিয়া কী?
মধুসূদনঃ ব্যাপারটা আমি অনেক আগে আঁচ করতে পেরেছিলাম। তাই বাংলা ভাষার এই অর্জন লক্ষ করে লিখেছিলাম তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য।
সুকান্তঃ মধুবাবু, আপনি মিথ্যা বলে সমস্ত গৌরব নিজের বলে চালিয়ে দিতে চাইছেন। ১৮ বছর বয়স মিথ্যা সহ্য করার নয়, ১৮ বছর···।
রবীন্দ্রনাথঃ থামো বাপু সুকান্ত, অনেক খোঁচাখুঁচি হইয়াছে। বলি, বাংলা ভাষাকে সবার পূর্বে বিশ্বদরবারে কে পৌঁছাইয়া দিয়াছে? বিশ্বকবি উপাধিটা কার আয়ত্তে রহিয়াছে শুনি?
নজরুলঃ গুরু, আমার মতো আপনাকে তো আর জেলে থেকে পচতে হয়নি। রুটির দোকানে কাজও করতে হয়নি। তাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘুরে ঘুরে বিশ্বকবি উপাধিটা নিতে পেরেছেন।
বঙ্কিমচন্দ্রঃ বাংলা ভাষার গদ্যে প্রাণসিঞ্চনরস সঞ্চিত করিবার একমাত্র গৌরব বঙ্কিমের। ইহা একপদমনোবাক্যে সকলেরই শীঘ্রই স্বীকার করিয়া লওয়া উচিত। আরও বলিবার আছে··· তবে আবার একটু জলবিয়োগ আসিয়াছে।
কায়কোবাদঃ বুঝতে পেরেছি, আজ এখানে বাংলা ভাষার আলোচনায় বঙ্কিমের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে পানিপথের চতুর্থ যুদ্ধ আসন্ন।
জীবনানন্দঃ আমাকে উঠতে হবে। বিকেলবেলা আমি আবার ট্রাম লাইনের ওপর দিয়ে হাঁটাহাঁটি করি। বয়স হয়েছে, শরীরটা তো ঠিক রাখতে হবে।
শরৎচন্দ্রঃ যান যান, জীবনানন্দ মশায়, আমরা সবই বুঝি। বনলতা সেনের সঙ্গে নিশ্চয় ডেটিং আছে। এক জীবনে আর কত, বলুন! সাবধান, এই বয়সে ছ্যাঁকা খাইয়া আবার দেবদাস না হইয়া যান।
মধুসূদনঃ ছ্যা, ছ্যা, সবার কথার ভেতরেই কাণ্ডজ্ঞানের বড় অভাব দেখিতেছি। সৃষ্টিশীল কিছুই হচ্ছে না। ভাবতে আমার কষ্ট হইতেছে যে আজ বাংলা ভাষার কবি-সাহিত্যিকদেরও এমন অধঃপতন।
রস+আলোঃ আজকের মতো গোলটেবিল আলোচনা এখানেই সমাপ্ত।
সূত্রঃ প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ০২, ২০০৯
Leave a Reply