সনাতন রূপঃ একটা ছোট ইঁদুর ঘুমন্ত সিংহের মুখের ওপর দিয়ে ছোটাছুটি করতে গিয়ে তার ঘুম ভাঙিয়ে দিল। সিংহ খুব রেগে ইঁদুরটাকে ধরে মেরেই ফেলছিল, তখন ইঁদুর খুব কাকুতি-মিনতি করে তাকে বলল, আমাকে ছেড়ে দাও, একদিন হয়তো আমি তোমাকে রক্ষাও করতে পারি।
ইঁদুরের কথা শুনে সিংহ হেসেই বাঁচে না, তবু কী মনে করে তাকে ছেড়ে দিল।
তারপর অনেক দিন পার হয়ে গেছে, হঠাৎ একদিন সেই সিংহ একটা শিকারির জালে আটকা পড়ে গেল। সিংহের গর্জন শুনে ইঁদুর ছুটে এসে তার ধারালো দাঁত দিয়ে জালের দড়ি কাটতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সিংহ মুক্তি পেয়ে যায়। ইঁদুর বলল, দেখেছ, তুমি আগে বিশ্বাস করোনি, কিন্তু প্রয়োজনে একটা ছোট ইঁদুরও তোমাকে রক্ষা করতে পারে।
সুবচনঃ ভালো কাজের প্রতিদান পাওয়া যায়।
আধুনিকঃ সিংহ একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির জিএম। নেংটি ইঁদুর সেই কোম্পানির পিয়ন। সিংহ প্রতিদিন দুপুরে লাঞ্চ করে তার এয়ার কন্ডিশন্ড ঘরে চেয়ারে হেলান দিয়ে একটা দিবানিদ্রা দেয় এবং তখন কেউ তাকে বিরক্ত করে না।
একদিন সিংহ তার দৈনন্দিন দিবানিদ্রা দিচ্ছে, তখন হঠাৎ করে একটা জরুরি ফাইলের দরকার পড়ল। নেংটি ইঁদুর পা টিপে টিপে সিংহের টেবিল থেকে ফাইলটি নিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ হাতে লেগে পানির গ্লাসটা নিচে পড়ে গিয়ে ঝন ঝন শব্দ করে ভেঙে গেল। সিংহ সেই শব্দে চমকে জেগে উঠল। ইঁদুরকে দেখে খপ করে ধরে ফেলে হুঙ্কার দিয়ে বলল, তোকে কতবার বলেছি ঘুমোনোর সময় শব্দ করবি না?
ইঁদুর কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ভুল হয়ে গেছে স্যার।
ভুল? সিংহ গর্জন করে বলল, আজ তোর একদিন কি আমার একদিন। তোর চাকরি যদি আমি এখন না খাই-তোকে আমি আস্ত গিলে খাব!
ইঁদুর হাত জোড় করে বলল, মাপ করে দেন স্যার। আর এই ভুল হবে না। ছেলেমেয়ের সংসার, না খেতে পেয়ে মারা যাব।
তুই মারা গেলে আমার কী? সিংহ চোখ লাল করে বলল, তোর মতো বেজন্মা অপদার্থ একটা নেংটি ইঁদুরের তো মরাই উচিত।
নেংটি ইঁদুর কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ও রকম করে বলবেন না স্যার, কিছু বলা যায় না, এ রকম তো হতেও পারে যে একদিন আপনাকে আমি বিপদ থেকে রক্ষা করব।
তুই বিপদ থেকে রক্ষা করবি আমাকে? সিংহ হঠাৎ হা হা করে হেসে উঠে বলল, তোর কথা শুনে আমি হেসে মরে যাই।
হাসতে হাসতে সিংহ বিষম খেয়ে যায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী মনে করে সে নেংটি ইঁদুরকে ছেড়ে দিল।
বছরখানেক পর এন্টিকরাপশন অফিসারেরা জাল পেতেছে দুর্নীতিপরায়ণ অফিসারদের ধরার জন্য। আর সেই সঙ্গে ধরা পড়ল সিংহ। কঠিন জাল, আটকা পড়ে প্রাণপণে চিৎকার করছে সিংহ। সেই চিৎকার শুনে তার পিয়ন নেংটি ইঁদুর ছুটে এল। জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে, স্যার?
দেখছিস না, এন্টিকরাপশনের জালে আটকা পড়েছি!
নেংটি ইঁদুর জালটা ভালো করে পরীক্ষা করে বলল, শক্ত জালে আটকা পড়েছেন স্যার। এই যে ফাঁসটা আপনার ঘুষ খাওয়ার ফাঁস। এইটা আপনার বিদেশি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের ফাঁস। এইটা অফিসের জিনিসপত্র নিজের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের ফাঁস। এইটা স্ত্রীর নামে বেআইনিভাবে সম্পত্তি কেনার ফাঁস। এইটা তহবিল তছরুপের ফাঁস। এইটা···
কথা বন্ধ কর নেংটি ইঁদুর। পারলে আমাকে বাঁচা।
নেংটি ইঁদুর বলল, কঠিন সমস্যা, তবে দেখি চেষ্টা করে।
তখন সে তার ধারালো দাঁত দিয়ে কুট কুট করে ফাঁস কাটতে শুরু করল। একটা একটা করে সবগুলো ফাঁস কেটে দেওয়ার পর সিংহ শেষ পর্যন্ত ছাড়া পেল। ইঁদুর দাঁত বের করে হেসে বলল, বলেছিলাম না স্যার, ছোট বলে অবহেলা করতে হয় না! এত বড় বিপদ থেকে আপনাকে উদ্ধার করে দিলাম কিনা?
সিংহ মাথা নাড়ল, বলল, তা ঠিক। আয় কাছে আয়।
নেংটি ইঁদুর কাছে এগিয়ে গেল, ভাবল, সিংহ নিশ্চয়ই এখন মোটা হাতে বকশিশ দেবে। কিন্তু ইঁদুর কাছে যেতেই সিংহ তাকে খপ করে মুঠোর মাঝে ধরে ফেলে বলল, তোকে আর বাঁচিয়ে রাখা যাবে না, তুই আমার সব কথা জেনে গেছিস। তোকে ছেড়ে দিলে সব জানাজানি হয়ে যাবে!
এই বলে সিংহ কপ করে ইঁদুরকে গিলে ফেলল।
দুর্বচনঃ ভেবেচিন্তে মানুষের উপকার করতে হয়।
[আধুনিক ঈশপের গল্প থেকে সংগৃহীত]
মুহম্মদ জাফর ইকবাল
সূত্রঃ প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৯, ২০০৮
Leave a Reply