ঢাকা বিমানবন্দরে নেমেই ঝামেলায় পড়লেন জেমস বন্ড। বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের (বিসিআই) আমন্ত্রণে একটা জটিল কেস সমাধানের জন্য ঢাকায় এসেছেন বন্ড। নামতে না নামতেই পকেট থেকে দামি মোবাইল ফোন আর পাসপোর্ট হাওয়া হয়ে গেল। বন্ড বেশ কয়েকবার পুলিশের একজন পদস্থ কর্মকর্তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে তিনি একজন বিদেশি নাগরিক। হারানো পাসপোর্ট আর মোবাইল ফোন খুঁজে বের করা পুলিশের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
পুলিশ কর্মকর্তা হেসে বললেন, ‘বাদ দেন স্যার, বেশি খোঁজখবর করলে আপনার আরও অনেক কিছু হারিয়ে যেতে পারে।’ বন্ডের সারা শরীরে চোখ বোলালেন তিনি। সতর্ক হলেন বন্ড। ঢাকা বিমানবন্দর থেকে জন্মদিনের পোশাকে বের হওয়া উচিত হবে না।
বাধ্য হয়ে ফোন বুথ থেকে বিসিআই হেডকোয়ার্টারে সব জানালেন বন্ড। এক ঘণ্টা পর বিসিআইয়ের গাড়ি তুলে নিল বন্ডকে। ড্রাইভার তাঁর মোবাইল ফিরিয়ে দিয়ে জানালেন, ইতিমধ্যে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে পাসপোর্টটা পাওয়া যায়নি। চিন্তার কিছু নেই। বিসিআইয়ে কাজী য়ানোয়ার হোসেন নামে একজন এক্সপার্ট রয়েছেন। তিনি বিদেশি জিনিস অবলম্বনে খাঁটি জিনিস বানাতে সিদ্ধহস্ত। আশা করি পাসপোর্টটা দুপুর নাগাদ হয়ে যাবে।
আর যা-ই হোক, বাংলাদেশের মেয়েরা খুব সুন্দর-মনে মনে প্রশংসা করতে বাধ্য হলো বন্ড ইলোরাকে দেখে। বন্ড তাঁর জন্য বিশেষভাবে তৈরি চশমাটা নাকের ওপর ঠেলে দিয়ে ইলোরাকে বললেন, ‘ম্যাজেন্টা কালারের লিপস্টিকটা তোমার ঠোঁটে দারুণ মানিয়েছে। হলফ করে বলতে পারি, আধঘণ্টার মধ্যে ওই লিপস্টিক অদৃশ্য হয়ে যাবে।’
‘কেমন করে? আমি তো আজ লিপস্টিকই লাগাইনি।’ খিলখিল করে হেসে উঠল ইলোরা।
অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন বন্ড। চশমার লুকানো বোতামটা বারবার টিপতে লাগলেন। কোনো কাজ হলো না।
‘তোমার কোনো যন্ত্রই বিসিআই ভবনে কাজ করবে না বন্ড’, ইন্টারকমে বজ্রকণ্ঠ ভেসে এল রাহাত খানের, ‘বিসিআই ভবনে ঢোকামাত্র ওগুলো অচল হয়ে গেছে আমাদের প্রযুক্তির কল্যাণে। ইলোরা, ওকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও।’
মনে মনে নিজেকে কষে একটা গালি দিল বন্ড। বিশ্বসেরা স্পাই কিনা বাংলাদেশে এভাবে নাকানি চোবানি খাচ্ছে! হাউ স্ট্রেঞ্জ!
“মাসুদ রানা কয়েক দিন ধরেই ডায়রিয়া আর ইনফ্লুয়েঞ্জায় ভুগছে। বাধ্য হয়ে তোমার বস ‘এম’-এর কাছ থেকে তোমাকে ধার করতে হয়েছে”-একটু বিরতি দিলেন বিসিআই চিফ রাহাত খান। ‘কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট থেকে আসল নোট পাচার করে কারা যেন নকল নোট রেখে আসছে। এই নাও ফাইল। এখানে সব ডিটেইলস পাবে; যদিও হাতের ছাপ বলতে প্রায় কিছুই নেই। হাতে চামড়ার গ্লাভস পরে কাজটা সারা হয়েছে।’ পাইপ থেকে ধোঁয়া ছাড়লেন রাহাত। বন্ডকে ইশারায় যেতে বললেন।
যদিও ফাইলে সবকিছু লেখা ছিল, তবু একদিন গ্রাহক সেজে বাংলাদেশ ব্যাংকে গেলেন বন্ড। খুঁজে খুঁজে বের করলেন সিকিউরিটি গার্ডকে।
‘হোয়াটস ইউর নেম, স্যার?’ প্রশ্ন করল গার্ড।
মাই নেম ইজ বন্ড-জেমস বন্ড, স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন বন্ড, ‘হোয়াটস ইউর?’
‘মাই নেম ইজ চৌধুরী। শাহরিয়ার চৌধুরী। আবু শাহরিয়ার চৌধুরী। মো· আবু শাহরিয়ার চৌধুরী। খান মো· আবু শাহরিয়ার চৌধুরী। রহমান খান মো· আ· শাহরিয়ার চৌধুরী। মিজানুর রহমান খান মো· আবু শাহরিয়ার চৌধুরী।’ ধৈর্য হারালেন বন্ড। বুঝতে পারলেন নিজের স্টাইলে নাম বলা বাংলাদেশে অন্তত চলবে না। ঠিক করলেন এভাবে নিজের নাম আর বলবেন না।
দুই·
গোদাগাড়ী। রাজশাহী।
প্রতি সপ্তাহে এখানে গরুর বিরাট হাট বসে। দেশিবিদেশি সব ধরনের গরুই পাওয়া যায় এখানে। বন্ডকে দেখা গেল মেলায় ঘোরাফেরা করতে। তাঁর দুচোখ কী যেন খুঁজছে। এক জায়গায় হঠাৎ থেমে গেলেন। এক লোক মাটিতে বসে তিন তাসের খেলা দেখাচ্ছে। লোকটা বলল, ‘আসুন, আসুন। নিজের ভাগ্যকে যাচাই করে নিন। দশ টাকায় ত্রিশ টাকা। এক শ টাকায় তিন শ টাকা। আসুন, আসুন।’ বন্ড দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ খেলা দেখলেন। জুয়া তাঁর রক্তে ঢুকে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও তাঁকে খরচের ব্যাপারে উদার হতে বলেছেন। কাজেই হয়ে যাক না এক দান জুয়া। দশ হাজার টাকাই বাজি ধরলেন তিনি। অবাক হয়ে দেখলেন, লোকটার হাত সাফাই সত্যি সত্যি অসাধারণ।
তিন·
দুদিন পর। ক্রিমিনালকে গলায় দড়ি দিয়ে বেঁধে টানতে টানতে বিসিআই অফিসে ঢুকলেন বন্ড। অফিসের সবার বি্নিত চোখ উপেক্ষা করে রাহাত খানের কক্ষে নক করলেন বন্ড।
‘কাম ইন’। রাহাত খানের বজ্রকণ্ঠ ভেসে এল।
ঢুকে পড়লেন বন্ড। ‘স্যার, এই যে ক্রিমিনাল। এর চামড়ার গ্লাভস দিয়েই বাংলাদেশ ব্যাংকে চুরির কাজটা সারা হয়েছে, স্যার। এই-ই স্যার আসল ক্রিমিনাল।’
বি্নিত রাহাত খান জেমস বন্ডের হাতে দড়ি বাঁধা গরুটা দেখলেন। বুঝতে পারলেন না দুজনের মধ্যে আসল গরু কোনটা। টাই দিয়ে বাঁধা যেটা-সেটা, নাকি দড়ি দিয়ে বাঁধাটা?
বিশ্বজিৎ দাস, প্রভাষক, দিনাজপুর সরকারি কলেজ, দিনাজপুর
সূত্রঃ প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৯, ২০০৮
Leave a Reply