[ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শকুন্তলা অবলম্বনে]
অতি পূর্বকালে ভারতবর্ষে দু্নন্ত নামে এক সম্রাট ছিলেন। সম্প্রতি তিনি জানতে পেরেছেন, বিশ্বের প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের তালিকায় সুন্দরবন স্থান পেয়েছে। তাই তিনি বেশ কজন বিশ্বস্ত সঙ্গীসাথি নিয়ে সুন্দরবনে মৃগয়ায় এসেছেন। সুন্দরবনের সুন্দর রূপ দেখে রাজা দু্নন্তের মন একেবারে দ্রব হয়ে গেল। প্রচণ্ড আবেগে তিনি গান গাইতে লাগলেন। গান শুনে আশপাশের গাছ থেকে বানরেরা প্রাণভয়ে দ্রুতবেগে পালাতে লাগল। রাজাও গান বন্ধ করলেন। কারণ তাঁর গান শুনে সব পশুপাখি পালিয়ে গেলে তিনি শিকার করতে পারবেন না। রাজা একটি অত্যাধুনিক জিপে বসেছিলেন। সুন্দরবন জিপ চালানোর জন্য উপযোগী না হওয়ায় তিনি হেঁটে হেঁটেই মৃগের সন্ধান করতে লাগলেন। কিন্তু কোথাও কোনো মৃগ দেখতে পেলেন না। রাজা বনের আরও গভীরে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেনাপতি রাজাকে বাধা দিতে চাইলেও ভয়ে কিছু বলতে পারলেন না।
দীর্ঘক্ষণ হাঁটার পর হঠাৎ একটা হরিণশাবক দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়ালেন রাজা। রাজাকে দেখেই হরিণশাবক দৌড়ে পালাতে লাগল। সম্ভবত রাজার গানের খবর তার কানেও পৌঁছে গেছে। রাজাও হরিণশাবকের পেছনে দৌড়াতে লাগলেন। বেশ কিছুক্ষণ দৌড়ানোর পর হরিণটাকে বাটে পেয়ে রাজা সেনাপতিকে আদেশ দিয়ে বললেন, ‘সেনাপতি, আমার তীর-ধনুক রেডি করো। হরিণশাবককে বাটে পাইয়াছি।’
সেনাপতি বললেন, ‘মহারাজ! এই ডিজিটাল যুগে তীর-ধনুক দিয়া হরিণশাবক মারিলে মানসম্মান এই বাদাবনের কাদায় গিয়া নিপতিত হইবে। এই বনের হরিণেরা অত্যন্ত বিটলা প্রকৃতির। তীর-ধনুকে এদের কিছু হয় না। আপনি এই উন্নত রাইফেল দিয়া হরিণ শিকার করুন।’ এই বলে সেনাপতি রাজার হাতে রাইফেল তুলে দিলেন। সামান্য হরিণশাবককে এত শক্তিশালী রাইফেল দিয়ে হত্যা করতে রাজার বিবেক সাড়া দিচ্ছিল না। পরক্ষণেই রাজা ভাবলেন ইসরায়েলের কথা। নিরীহ মানুষকে মারতে ইসরায়েল যদি হোয়াইট ফসফরাস ব্যবহার করতে পারে, তাহলে হরিণ মারতে তিনিও রাইফেল ব্যবহার করতে পারবেন। রাজা হরিণশাবকের দিকে রাইফেল তাক করলেন। এমন সময় চারপাশ থেকে ধুপধাপ আওয়াজ করে অদ্ভুত পোশাক পরা কতগুলো মানুষ এল। রাজা ভাবলেন, এরা নিশ্চয়ই সুন্দরবনের তপস্বী। রাজা একটু মনঃক্ষুণ্ন হলেন। এই তপস্বীদের জন্যই তিনি তপোবনে বাটে পেয়েও হরিণ মারতে পারেননি। এখানেও একই ঘটনা।
তপস্বীদের মধ্যে একজন দুই হাত তুলে উচ্চ স্বরে বলল, ‘খবরদার! এইটা আমাগো এলাকার হরিণ। এরে মারার চেষ্টা করলে পিটাইয়া হাঁটুর বাটি খুইলা ফালামু।’
রাজাকে অপমান! সেনাপতি গর্জে উঠলেন, ‘খামোশ! ওহে পামর, বর্বর, তোমরা চন্দ্রবংশীয় রাজা দু্নন্তের সঙ্গে বেয়াদবি করছ। আমি চাইলে এখনই তোমাদের গ্রেপ্তার করতে পারি।’ সেনাপতির কথায় ওরা হাসতে হাসতে বলল, ‘মহারাজ, আপনার অস্ত্র বাসায় রেখে দেওয়ার জন্য, হরিণ মারার জন্য নয়।’ আরেকজন বলল, ‘শোনেন, এইটা ত্যাড়া আক্কাসের এলাকা। চলেন আমাদের সঙ্গে। ওস্তাদের দাওয়াত কবুল করেন। ওরা রাজাকে ধরতে এগিয়ে আসতেই সেনাপতিসহ রাজার সঙ্গীরা অস্ত্র তাক করল। কিন্তু ওরাও পাল্টা অস্ত্র তাক করল। ওদের অস্ত্রগুলো আরও আধুনিক। সঙ্গী সাথিসহ ত্যাড়া আক্কাস বাহিনীর হাতে আটক হয়ে রাজা বনের আরও গভীরে প্রবেশ করলেন। রাজা ভাবলেন, ত্যাড়া আক্কাস নিশ্চয়ই অনেক বড় তপস্বী। কিন্তু তার লোকজনের ব্যবহার মোটেই ভালো নয়। এ ব্যাপারে তিনি ত্যাড়া আক্কাসের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে ঠিক করলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘মহর্ষি কি আস্তানায় আছেন?’ একজন বলল, ‘জি না, উনি জরুরি কাজে সিঙ্গাপুর গেছেন। তবে ওনার পালিত কন্যা শকুন্তলা আছেন, তিনিই আপ্যায়ন করবেন।’
পথের ধারে গুলির খোসা, সিগারেটের বাঁট দেখে রাজা বুঝলেন, তিনি আস্তানার কাছে চলে এসেছেন। আস্তানার কাছে আসতেই রাজার বাম চোখ লাফাতে লাগল। সুন্দরবনে বিপদসূচক লক্ষণ দেখে রাজা বি্নিত হলেন। অতঃপর আস্তানায় প্রবেশ করে রাজা দেখলেন, গাছের নিচে একজন অতি রূপবতী তরুণী বসে আছে। ত্যাড়া আক্কাসের একজন লোক বলল, ‘ম্যাডাম, এরা হরিণ মারতে আইছে। মালপানি ভালোই আছে। কী করুম?’ রাজা বুঝলেন ইনিই শকুন্তলা। শকুন্তলার রূপে রাজা মুগ্ধ হয়ে শকুন্তলাকে বললেন, ‘তোমার অধরে নবপল্লবশোভার আবির্ভাব; বাহুযুগল কোমল বিটপের মতো বিচিত্র শোভায় বিভূষিত। এরূপ রূপবতী আমার অন্তঃপুরেও নাই।’
শকুন্তলা ঈষৎ হাস্য করিয়া বলিল, ‘এই কে আছিস, এদেরকে সাইজ কর।’
আদনান, মিরপুর, ঢাকা
সূত্রঃ প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৯, ২০০৮
Leave a Reply