ব্যাংকে গেলেই আমার কেমন যেন ভয় লাগে। ব্যাংকের ক্লার্ক থেকে শুরু করে দরজা-জানালা, কাউন্টার, টাকা-সবকিছু আমাকে ভীষণ নার্ভাস করে দেয়।
কিন্তু হঠাৎ আমার মাসিক আয় ৫০ ডলার বেড়ে গেল। ভেবে দেখলাম, এই টাকা জমানোর জন্য ব্যাংকই সবচেয়ে উপযুক্ত।
একদিন অনিচ্ছা সত্ত্বেও ব্যাংকে গেলাম। ঢুকেই ক্লার্কের দিকে লাজুকভাবে তাকালাম। আমার ধারণা ছিল, অ্যাকাউন্ট খুলতে ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপ করতে হয়।
‘অ্যাকাউন্ট্যান্ট’ লেখা কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেলাম। তিনি এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন যে আমি ভিরমি খেয়ে গেলাম। গলাটাকে যথাসম্ভব গম্ভীর করে বললাম, ‘আমি কি ম্যানেজারের সাথে দেখা করতে পারি? একা।’ আমি নিজেও বুঝতে পারলাম না ‘একা’ শব্দটা কেন উচ্চারণ করলাম।
‘অবশ্যই পারেন’ বলে অ্যাকাউন্ট্যান্ট ম্যানেজারের খোঁজ নিতে গেলেন।
ম্যানেজারকে দেখে রাশভারী লোক মনে হলো। বোকার মতো প্রশ্ন করলাম, ‘আপনিই কি ম্যানেজার?’
‘হ্যাঁ,’ তিনি জবাব দিলেন।
‘আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারি কি? একা।’ আবারও কেন অহেতুক ‘একা’ যোগ করলাম, নিজেই বুঝতে পারলাম না। ম্যানেজার আমাকে সতর্কভাবে জরিপ করলেন। তাঁর ধারণা, আমি চরম গোপন কোনো কিছু তাঁর কাছে ফাঁস করতে এসেছি। ‘ভেতরে আসুন’ বলে তিনি আমাকে তাঁর ব্যক্তিগত কামরার দিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন। দরজায় তালা লাগিয়ে আমার দিকে ঘুরে তিনি বললেন, ‘এখানে আমরা নিরাপদ। বসুন।’ আমরা বসে পরস্পরের দিকে তাকালাম। আমি কথা বলতে চাইলাম, কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো স্বর বের হলো না।
ম্যানেজার বললেন, ‘আমার ধারণা, আপনি পিংকারটন থেকে এসেছেন।’
আমার রহস্যময় আচরণের কারণে ম্যানেজার আমাকে ডিটেকটিভ ভেবে বসেছেন। এটা বুঝতে পেরে আরও ঘাবড়ে গেলাম। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললাম, ‘না, না, পিংকারটন থেকে নয়। আসলে আমি একটা অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য এসেছি।’
ম্যানেজারের উদ্বেগ কিছুটা কেটে গেল। তিনি এখন সম্ভবত ভাবতে শুরু করেছেন, আমি কোনো বড়লোকের সন্তান। তিনি বললেন, ‘ধারণা করছি, আপনি খুব বড় অঙ্কের টাকা রাখবেন।’
‘অবশ্যই বড় অঙ্কের,’ আমি ফিসফিস করে বললাম, ‘আমি এখন ৫৬ ডলার রাখতে চাই। আর প্রতি মাসে ৫০ ডলার করে জমা রাখব।’
আর একটা কথাও না বলে ম্যানেজার উঠে দাঁড়ালেন। তারপর অ্যাকাউন্ট্যান্টকে চড়া গলায় জানালেন, ‘মিস্টার মন্টোগোমারি, এই ভদ্রলোক অ্যাকাউন্ট খুলতে চান।’
তারপর আমার দিকে ফিরে ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘গুড মর্নিং।’
আমি উঠে দাঁড়িয়ে অ্যাকাউন্ট্যান্টের সাথে গেলাম। তারপর ঝট করে টাকাগুলো তার টেবিলের ওপর ছুড়ে দিলাম, যেন আমি কোনো জাদুর কৌশল দেখাচ্ছি। কাঁপা গলায় বললাম, ‘এই টাকাগুলো আমার অ্যাকাউন্টে রাখুন।’
অ্যাকাউন্ট্যান্ট কথা না বলে টাকাগুলো ক্লার্কের দিকে ছুড়ে দিয়ে একটা ফরম বের করে আমাকে সিগনেচার করতে বললেন। আমি কী করছি কিছুই বুঝতে পারলাম না। পুরো ব্যাংক আমার চোখের সামনে ঘুরতে লাগল। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমার অ্যাকাউন্ট কি খোলা হয়ে গেছে?’ অ্যাকাউন্ট্যান্ট বললেন, ‘হ্যাঁ, হয়ে গেছে।’ ‘তাহলে আমাকে একটা চেক দিন, কিছু টাকা তুলব।’
কেউ একজন আমার হাতে একটা চেক বই ধরিয়ে দিলেন। আরেকজন বুঝিয়ে দিলেন কোথায় কী লিখতে হবে। কোনোমতে চেকটা লিখে ক্লার্কের হাতে দিলাম। চেকটা দেখে তাঁর চোখ কপালে উঠে গেল, ‘আশ্চর্য! আপনি কি সব টাকা তুলে নিতে চান?’ আমি বুঝতে পারলাম, ছয় ডলারের বদলে ৫৬ ডলার লিখে ফেলেছি! ভুলটা এখন বুঝিয়ে বলা অসম্ভব ব্যাপার। অন্য ক্লার্করা কাজ থামিয়ে আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালেন। যা হওয়ার হবে ভেবে একটু কঠিন স্বরে বললাম, ‘হ্যাঁ, পুরো টাকাই তুলতে চাই আমি।’
‘আপনি কি আপনার অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিতে চান?’ ‘নিশ্চয়ই, আমি তা-ই চাই।’ ‘কিছু টাকাও জমা রাখবেন না?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন এক ক্লার্ক। আমি বললাম, ‘না।’
ক্লার্ক হয়তো ভাবছেন, তাঁদের কথায় বা আচরণে আমি ক্ষুদ্ধ হয়েছি, তাই অ্যাকাউন্ট বন্ধ করতে চাইছি। তাঁরা যেন সে রকমই ভাবেন, এ জন্য মুখভঙ্গি ক্রুব্ধ করে তোলার চেষ্টা করলাম। ক্লার্ক আমাকে টাকা দেওয়ার বন্দোবস্ত করলেন। তিনি বললেন, ‘কত নোটে দেব?’
তাঁর কথা আমি বুঝতে না পেরে বললাম, ‘কী বললেন?’
‘আপনি কত ডলারের নোট চান?’
এবার বুঝতে পারলাম। কোনো চিন্তা না করেই উত্তর দিলাম, ‘৫০ ডলারের নোটে দিন।’
তিনি আমাকে একটা ৫০ ডলারের নোট দিয়ে শুষ্ক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাকি ছয় ডলার?’ আমি বললাম, ‘এক ডলারের নোটে দিন।’
তিনি আমার হাতে টাকাটা দিতেই আমি তাড়াতাড়ি সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম।
ব্যাংকের বড় দরজা পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পেছনে সমবেত কণ্ঠে প্রচণ্ড অট্টহাসি শুনতে পেলাম। বিল্ডিংটাই যেন হাসির শব্দে ফেটে পড়বে।
বুঝতেই পারছেন, তারপর থেকে আমি আর ব্যাংকে যাই না। এখন আমার টাকা পকেটেই রাখি। জমানোর মতো হলে একটা মোজার মধ্যে রেখে দিই।
রূপান্তরঃ শারমীন আফরোজ
স্টিফেন বাটলার লিককঃ (১৮৬৯-১৯৪৪) কানাডিয়ান লেখক ও অর্থনীতিবিদ। তিনি স্যাটায়ারধর্মী ননসেন্সে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মগুলো হচ্ছে লিটারারি ল্যাপস, ননসেন্স নভেল, আক্রেডিয়ান অ্যাডভেঞ্চার উইথ দি আইডল রিচ ইত্যাদি।
স্টিফেন লিকক
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১২, ২০০৮
Leave a Reply