ভাই বিদেশ থাকতেন। কিন্তু দীর্ঘদিন তাঁর কোনো খোঁজখবর ছিল না। হঠাৎ একদিন বিদেশ থেকে চিঠি লিখলেন, তিনি দেশে টাকা পাঠাবেন। বললেন অ্যাকাউন্ট আইডি পাঠাতে। ছোট ভাই তাঁর যত ইয়াহু আর জি-মেইল অ্যাকাউন্ট আইডি ছিল, সবই পাঠিয়ে দিয়েছে।
ডিজিটাল যুগের ছেলেমেয়েদের বন্ধুবান্ধবের সংখ্যাটা সঠিক বলা যায় না। ফেসবুক, হাই-ফাইভসহ এ রকম আরও অনেক সাইট আছে, যারা বন্ধুত্বের অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে দুনিয়াজুড়ে। দিন-রাত চলে ছোট্ট রুমে বসে আড্ডা, ইংরেজিতে বলে চ্যাট। কিন্তু এদের কতজনের সঙ্গে সশরীরে সাক্ষাৎ হয়েছে? নেটে চ্যাট হচ্ছে, মেইল পাঠানো, প্রতিদিন প্রোফাইলের ছবি আপডেট হচ্ছে, এরপর আবার সশরীরে দেখা হওয়ার কী দরকার? সবকিছু মিলিয়ে তো বন্ধুটির সম্পর্কে আগাপাছতলা একটা ডিজিটাল ভিউ তৈরি হয়েই গেছে।
এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে দাওয়াত দিয়েছে আড্ডার, ঠিক সাতটায় উপস্থিত থাকতে। কিন্তু বন্ধুটি সময়মতো আসতে পারছে না বলে ফোনে কল দিয়ে বলছে, ‘দোস্ত, বাসায় বিদ্যুৎ নাই, আইপিএসও ড্যাম, বিদ্যুৎ এলেই আড্ডায় (চ্যাটরুমে) ঢুকব।’
এখন ফেসবুকই সবচেয়ে বড় রেস্টুরেন্ট। দিন-রাত এ-ওকে ফ্রাইড চিকেন থেকে শুরু করে ঠান্ডা পানীয়-সবই পাঠাতে পারছে। খেতে ডাকলে ছেলেমেয়েরা জবাব দিচ্ছে, ‘আরেকটু, বার্গারটা ডাউনলোড হতে সময় লাগবে, বিগ সাইজ কি না!’ অথচ ইন্টারনেটিং শেষ করেই সে বলে ওঠে, ‘মা, টেবিলে ভাত দাও, খাব।’ তাহলে এতক্ষণ যা খেলি তাতে কী উপকারটা হলো, বিগ সাইজ বার্গারটা নামানোরই বা অর্থ কী? প্রতিদিন এভাবে যে পরিমাণ হিউম্যান আওয়ার ইন্টারনেটিংয়ে আনপ্রোডাক্টিভলি ব্যয় হচ্ছে, তা এক করলে কী করা যেত, সেটা হিসাব কষে বলতে হবে। ভালো কিছু তো বটেই।
এখনকার বন্ধুবান্ধব বাসায় আসার আগে মানুষজনের খবর না নিয়ে জিজ্ঞেস করে, বাসায় নেট আছে তো?
ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েভ,
এমনই জালে জড়ালে গো ধরা,
তোমাতেই মজেছে সকলে,
মানবিকতা রয়ে গেল অধরা।
বছরে কয়টা নতুন জাতের ধান, খাদ্যশস্য আবিষ্কার হচ্ছে আর কয়টা নতুন প্রযুক্তি আসছে বাজারে? সিআরটি মনিটর বদলে নতুন করে একটা এলসিডি মনিটর কেনো, ওটা চোখের জন্যও ভালো, দেখতেও সুন্দর। বিজ্ঞাপনে এলসিডির পাশে ্লিম সুন্দরীর সহাবস্থানটাও নজরকাড়া।
মোবাইল ফোন আমাদের অনেক কাজই সহজ করে দিয়েছে, এটা সত্য। কিন্তু আমাদের মতো দেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ টাকা মোবাইল ফোনে কেবল অপ্রয়োজনীয় কথা বলে ওড়ানো হয়, তার কত ভাগ টাকা বছরে খাদ্য উৎপাদনে ব্যয় হয়? এই হিসাবটা আমার জানা নেই, জনাব শাইখ সিরাজ, আপনি একটি উদ্যোগ নিতে পারেন। যা-ই হোক, ডিজিটাল যুগে মানুষকে ডিজিটালি ভুক্ত রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে, না হলে কাঁহাতক আর অভুক্ত শরীরে ডিজিটাল বিনোদন সহ্য হবে? মন বিদ্রোহ করলে শরীর ভোগে, কিন্তু যখন শরীর বিদ্রোহ করবে তখন?
একটি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলের বিজ্ঞাপনে লেখা হলো তাদের স্কুলের মতো এত বড় প্লে-গ্রাউন্ড আর কারও নেই। একসঙ্গে সব ছেলেমেয়ে যা ইচ্ছা খেলতে পারবে। জায়গা-জমির এই দুর্মূূল্যের যুগে এমন কথা শুনে কার না স্কুলটি দেখতে ইচ্ছে করে! পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেল প্লে-গ্রাউন্ড বলতে মাঝারি সাইজের একটি কক্ষ। সেখানে দুই শতাধিক কম্পিটারের মনিটর পিটপিট করে জ্বলছে। ছেলেমেয়েরা সেখানে কেউ ফুটবল, কেউ ক্রিকেট, কেউ ক্রস-পাজল, কেউ মোটর-রেস, কেউ কমান্ডো খেলা নিয়ে দারুণ ব্যস্ত। দারুণ ডিজিটাল উত্তেজনা। এ-ওকে গোল দিচ্ছে, কেউ ছক্কা হাঁকাচ্ছে, কেউ মাইকেল শুমেখারকে পেছনে ফেলে দারুণ উচ্ছ্বসিত, কেউ আবার কমান্ডো হয়ে ইয়া বড় বড় শত্রুঘাঁটি নিমিষেই গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। অথচ এদের কেউই সকালে একা একা স্কুলে আসতে পারে না, ছুটি হলে বাবা-মা-চাচা-বুয়ার জন্য গেটে অসহায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, বইয়ের ওজনে ঠিকমতো সোজা হয়ে হাঁটতেও ওদের কষ্ট হয়। এখনকার আন্ডা-বাচ্চারা ঠিকমতো হাঁটতে না পারলেও কম্পিউটার ওপেন করে ঠিকই মোটর-রেসে অংশ নিতে পারে। ডিজিটাল যুগের ডিজিটাল বাচ্চা-কাচ্চা, বড় হয়ে বাস্তববাদী (অ্যানালগ) মানুষ হবে, এটাই আশা।
ডিজিটালের ভেতরে এখনো অ্যানালগ। বলেছি যখন, ব্যাখ্যা করা জরুরি। ডিজিটাল এসেছে ডিজিট থেকে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে পর্দায় সংখ্যা, ছবি ভাসবে। কিন্তু পর্দায় এই সংখ্যা আর ছবি ফুটে ওঠার আড়ালে আছে অনেকগুলো ছোট বাতির জ্বলা-নেভা। ঠিক যেমন বাসায় ১০০ ওয়াটের বাতিটি জ্বলে ও নেভে। আর আছে শক্তি, যা খেয়ে বাতিগুলো জ্বলে। অতএব এটা পরিষ্কার, খাওয়া এবং সেই অ্যানালগ জ্বলা-নেভা ছাড়া ডিজিটাল প্রযুক্তি অসম্ভব। সুতরাং, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ডিজিটাল বাংলাদেশ বানানোর ঘোষণা দিয়েছেন ভালো কথা, এবার সবার জন্য সহজলভ্য খাদ্য নিশ্চিত করুন, ডিজিটাল এমনিতেই হয়ে যাবে। কৃষকেরা নিশ্চয় মাঠে সারের বদলে ডিজিট ছিটাবে না, কিংবা ফসলের বিনোদনের জন্য এমপিথ্রিও বাজাবে না। মানুষ ডিজিটাল বুঝলেও মাঠের ফসল ডিজিটাল বোঝে না। বোঝে খাদ্য, বোঝে সার। বাঁচার জন্য ওটাই মূল কথা-ফসলই হোক আর মানুষই হোক।
তাওহিদ মিলটন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১২, ২০০৮
Leave a Reply