ইতিহাসে রাজনৈতিক মতলবে জুতা-বন্দনা সাহিত্য পদ-বন্দনার চেয়ে প্রাচীন। এই সেদিন, মাত্র কয়েক শ বছর আগে, জয়দেব গদগদ হয়ে শ্রীরাধাকে বললেন, ‘দেহি পদপল্লব মুদারম।’ অথচ তার হাজার বছর আগে শ্রীরামচন্দ্র বনবাসে রওনা হলে তাঁর ভাই ভরতচন্দ্র রামচন্দ্রের জুতাজোড়া পা থেকে খসিয়ে নিয়ে এসে সিংহাসনের ওপর রেখে দিব্যি আয়েশে ১২ বছর রাজত্ব করলেন। পায়ের ব্যবহার কবি-সাহিত্যিকদের পদ-বন্দনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও জুতার বহুমুখী ব্যবহার বিবর্তনের ধারায় অতি চমৎকার ক্রমবিকাশমান। মধ্যযুগে জুতা ব্যবহারের বহুমুখী ধারা খানিকটা ঝিমিয়ে থাকলেও আধুনিককালে রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা আবিষ্কারের’ আগেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এ ব্যাপারে বেশ একধাপ এগিয়ে গিয়েছিলেন। একবার কলকাতায় মঞ্চনাটক দেখতে গিয়ে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে দুর্যোধনবেশী মঞ্চাভিনেতার দিকে ঈশ্বরচন্দ্র এক পাটি পাদুকা ছুড়ে মেরেছিলেন। ওই ঘটনায় ধনী এবং দানবীর ঈশ্বরচন্দ্রের মনের বড়ত্ব নিয়ে প্রশ্ন জাগা খুবই স্বাভাবিক। তাঁর ছুড়ে মারা পাদুকা ছিল নম্বরবিহীন চটি-তাও দুই পাটি নয়, মাত্র এক পাটি।
জুতা ব্যবহারের বিবর্তনের পথ বেয়ে একবিংশ শতাব্দীর তরুণ ইরাকি জাইদি ঈশ্বরচন্দ্রের তুলনায় অনেক বড় মনের পরিচয় দিয়েছেন। ইরাকের চরম আর্থিক দুর্দশার দিনেও তিনি এক পাটি নয়, পুরো একজোড়া এবং সস্তা চটি চপ্পল নয়, খাঁটি চামড়ার তৈরি ১০ নম্বর অক্সফোর্ড শু দিল খুলে বুশ সাহেবকে দান করেছেন।
দুনিয়াব্যাপী মহামন্দা সৃষ্টির মহানায়ক বুশ সাহেব সম্প্রতি তাঁর নিজ দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচাতে গিয়ে বিলিয়ন ডলারের বেল-আউট প্রোগ্রাম নিয়েছেন। অর্থাৎ সরকারি কোষাগার চেঁছেপুছে সব টাকা দেশের লোকসানি ব্যবসায়ীদের গাঁটে তুলে দিয়ে শেষরক্ষার জন্য তাঁর পেরেশানির শেষ নেই। অথচ তৃতীয় বিশ্বের ব্যবসায়ীরা এদিক দিয়ে একেবারেই এতিম। চামড়া ব্যবসায়ীদের কথাই ধরা যাক। মহামন্দার তাণ্ডবে বেচারারা একেবারে দিশেহারা দিগ্বিদিকশূন্য। তবে এ সপ্তাহে ঘটে যাওয়া ইরাকি জাইদির ঘটনায় চামড়া ব্যবসায়ীরা এবার সুড়ঙ্গের শেষে উজ্জ্বল আলোর সন্ধান পেয়েছেন। বুশ সাহেবের চাঁদমুখ লক্ষ করে ছুড়ে দেওয়া পুরো একজোড়া নয়, স্রেফ এক পাটি জুতার বাজারমূল্য এখন এক কোটি ডলার। সেই হিসাবে একজোড়া জুতার দাম দুই কোটি ইউএস ডলার। অর্থাৎ বাংলা টাকার বর্তমান মান হিসাবে একজোড়া জুতার দাম ১৫৬ কোটি টাকা। ধনী দেশের ব্যবসা বাঁচানোর জন্য বুশ সাহেবেরা সরকারি কোষাগার ভেঙে বিলিয়ন ডলারের বেল-আউট প্রোগ্রাম নিয়েছেন। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের চামড়া ব্যবসায়ীদের বাঁচানোর জন্য জাইদির বেল-আউট প্রোগ্রাম নিজগুণে নিঃসন্দেহে ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এ কাজে কোনো দেশের সরকারি কোষাগারে হাত দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। বিশ্বসংসারে এমন মহতী উদ্যোগের সাফল্যের জন্য এখন বাগদাদ শহরে ধারণকৃত কয়েক সেকেন্ডের বিজ্ঞাপনচিত্রটির ব্যাপক প্রচার প্রয়োজন। তবে ২০০৯-এর ২০ জানুয়ারির পরে বিজ্ঞাপনচিত্রের মডেল হিসেবে বুশ রয়্যালটি দাবি করে বসলে বেচারাকে দোষ দেওয়া উচিত হবে না। কারণ, মহামন্দার প্রভাবে বুশের পেটেও ছুঁচোর কেত্তন শোনা যেতে পারে।
তুষার কণা খোন্দকার
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ০৫, ২০০৮
Leave a Reply