আমার বন্ধু জগলু এক বন্ধ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ঘাড় নাড়িয়ে নাড়িয়ে কী যেন বলছে। তার সামনে দাঁড়ানো ছিল তিন ষণ্ডামার্কা ছেলে। ছেলেগুলোর চুল ঘাড় ছাড়িয়ে নিচের দিকে নামানো। না-কামানো দাড়িগুলো খোঁচা খোঁচা আকৃতি নিয়ে অবস্থান করছে চোয়ালে। আমাকে দেখেই জগলু চেঁচিয়ে উঠে দৌড়ে এসে পেঁচিয়ে ধরল। ঈদের কোলাকুলিটা বাকি ছিল বোধ হয়। তারপর প্রায় টেনে নিয়ে চলল সেই ছেলেগুলোর কাছে। একজন আমাকে দেখে বলল, ‘আমাদের দলে আছ তো হে?’ আমি কিছু বলার আগেই জগলু বলল, ‘আছে মানে, নির্ঘাত আছে, ওর মতো দলভক্ত ছেলে এ পাড়ায় দুটি নেই।’ শুনে ‘সাবাস’ বলে তিনজনে একসঙ্গে আমার পিঠ চাপড়ে দিল। তিন চাপড়ের ধাক্কায় আমি সামনে হেলে পড়ি। কত বড় নচ্ছার এ জগলুটা, কী মিথ্যাটাই না বলল আমার নামে।
যা-ই হোক, খানিক পরে দেখি একজন জগলুর হাতে কিছু কড়কড়ে নোট ধরিয়ে দিল। আর যাওয়ার প্রাক্কালে আরেকজন ডান পকেট থেকে অন্যজনের বাঁ পকেটে কৌণিক আকৃতির এক ধাতব বস্তু স্থানান্তর করল। তা দেখে যদিও আমার হৃৎপিণ্ডে কাঁপন ধরল, তবে এমন ভাব ধরলাম যে এ আর এমন কী! ফুঁ!
দুপুরে একটু তন্দ্রামতো এসেছিল। ঠিক তখনই কানে এল জগলুর চেঁচানি। ওর ওই বেসুরো গলায় আমার নাম ধরে একমনে এমনভাবে চেঁচাচ্ছে যে ওতে মৃত মানুষও জেগে উঠলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। নতুন কেনা শার্টটা গায়ে চড়িয়ে আর মাথায় এক খাবলা জেল ঢেলে রাস্তায় বেরোই। আমাকে দেখেই জগলুও হাসা শুরু করল-কী যে হাসি, হাসি যে কত রকমের হতে পারে তা প্রথম উপলব্ধি করলাম। টানা দুই মিনিট হাসল নিরবচ্ছিন্নভাবে। রাস্তায় ছোট ছেলেদের জটলা বেঁধে গেল।
‘এত হাসলি ক্যান?’ আমি রেগেমেগে ওকে জিজ্ঞেস করি।
‘আরে না না, যা ভাবছিস তা নয়। তোর চেহারা দেখে হাসি পায় ঠিকই। কিন্তু আমি অতটা অভদ্র নই। আসলে সেদিন কেমিস্ট্রি ল্যাব ক্লাসে হঠাৎ করে খানিকটা নাইট্রাস অক্সাইড, মানে লাফিং গ্যাস দেহে ঢুকে পড়ে। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, তখন একটুও হাসি পেল না; বরং মুখ গোমড়া করেই বাড়ি ফিরলাম। তারপর থেকে মাঝেমধ্যেই বুদবুদের মতো খানিকটা করে বের হয় আর হাসতে হাসতে মারা যাই প্রায়। কেমিস্ট্রি বিষয়টাতেই খুব মিস্ট্রি আছে, বুঝলি।’
আমি বললাম, ‘সে যাক, কিন্তু ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছিলি কেন, শুনি?’
‘কেন, ভুলে গেলি, দলের হয়ে কাজ করতে হবে না?’
‘দেখ জগলু, এসব রাজনীতির রীতিনীতি আমার ধাতে সয় না। তোদের রাজনৈতিক কাজে নৈতিক ব্যাপারস্যাপার খুব দুর্লভ। তা ছাড়া তোদের যে মার্কা, তাতে তোদের নেতার জেতার সম্ভাবনা তো হিমাঙ্কের নিচে।’
শুনে ও মুখ গোমড়া করে বলল, ‘তুই আমাদের বদনা মার্কা নিয়ে উপহাস করলি! তুই জানিস এই মার্কার বদৌলতে আমাদের নেতা কেরামত ভাইকে দশ এলাকার মানুষ এক নামে চেনে। চল, আর বেশি বকিস না, এখন কেরামত ভাই ভাষণ দেবেন মাঠে, তোকে না দেখলে কিন্তু বড় ভাইয়েরা মাইন্ড করবে।’
অগত্যা ওর সঙ্গে রওনা দিই। পথে যেতে যেতে ও আমাকে বোঝাতে থাকে-কেরামত আলী ক্ষমতায় এলে আমাদের কিরূপ প্রবৃদ্ধি হবে, ক্যাডার ভাইদের ছায়াতলে, ছলে বলে কত ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করা যাবে!
মাঠে গিয়ে দেখি বেশ বড় জনসমাবেশ। কেরামত আলীর লোকেরা এলাকার সব মানুষকে ধরে ধরে নিয়ে আসছে সমাবেশে।
জগলু আর আমি গিয়ে বসি সামনের সারিতে। বড় ভাইয়েরা এসে এক ফাঁকে বলে গেল, ‘হাতে তালি দিয়া আজকে হাতে ঘা বানায়া ফেলবি, বুঝছস, টিভি ক্যামেরা আসতেছে।’
নেপথ্যে স্লোগান চলছিল-
কেরামত ভাইয়ের চরিত্র-ফুলের মতন পবিত্র
ব্রিজ করব মেরামত-আমগো নেতা কেরামত
স্কুল করব মেরামত-আমগো নেতা কেরামত।
নানা পাতিনেতার পর শেষমেশ কেরামত আলী তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন। তিনি বললেন, ‘ভাইসব, আপনারা অনেকে আমার মার্কা নিয়া উপহাস করেন, টিজ করেন। আপনারা জানেন, মানবজীবনে বদনার গুরুত্ব কতটুকু। আমাদের প্রত্যেককেই দৈনিক একাধিকবার বদনা ব্যবহার করতে হয়। আর সবচেয়ে বড় কথা-আমার চরিত্র যে কী, তা আমার মার্কার মাধ্যমে সুন্দরভাবে প্রস্কুটিত হইছে। যেমন, আমি বদ না।’
যখন কেরামত মিয়া এলাকাবাসীর দুঃখ-দুর্দশায় চমৎকার অভিনয়কলা প্রদর্শনপূর্বক মেকি কান্না কাঁদছিলেন আর তাঁকে ভোটে জয়ী করলে কিরূপে তিনি উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দেবেন, এসব বলছিলেন, তখন হঠাৎ মনে হলো, পাশ থেকে ভাইব্রেশন হচ্ছে। ব্যাপার কী-দেখি, জগলু রীতিমতো দাঁতে দাঁত চেপে কাঁপছে-নিশ্চয়ই আবার লাফিং গ্যাস বুদবুদিয়ে উঠছে, আমি আশঙ্কা করলাম। তখন কেরামত আলীর মায়াভরা গলা ছাড়া পুরো জায়গায় আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। হঠাৎ দমকা হাওয়ার মতো হাসির এক ঢেউ উঠল জগলুর পেটের ভেতর থেকে। আমি ওকে ধরার আগেই হো হো, হি হি-নানা রকম শব্দ বেরোতে লাগল ওর মুখ দিয়ে। হাসির একেবারে অগ্ন্যুৎপাত। বাঙালিরা স্বভাবতই স্পর্শকাতর। কেউ যদি কোনো কারণে হাসে, তাহলে সে হাসি দেখেই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায় অনেকে। কারণ না জেনেই। আর কেউ হাসলে ভদ্রতা করেও নাকি হাসতে হয়। সে ভদ্রতাজ্ঞান দেখলাম সবার মধ্যে প্রচুর। তাই প্রথমে আমাদের আশপাশের কয়েকজন শুরু করল, তারপর ক্রমে পুরো জনসমাবেশের সবার মধ্যেই সংক্রমিত হলো। কেরামত সাহেবের বক্তৃতা এ হাসির হুল্লোড়ে অনেক আগেই থেমে গেছে, এখন বিষাদভরা নয়নে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা হাসির এ হুল্লোড় থামানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু জেগেছে বাঙালি, কে রোখে!
এ ঘটনার পর বেশ কিছুদিন ধরে কেরামত আলীর নির্বাচনী প্রচারণা বন্ধ আছে। শুনেছি কেরামত আলীর সাঙ্গোপাঙ্গরা জগলুকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর কিছুদিন পরই নির্বাচন, বদনা মার্কার হার হলে তার দায়ভারের কিছু অংশ যে জগলুর ঘাড়েও বর্তাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ওর কোনো খোঁজখবর নেই, কোথায় ডুব দিয়েছে কেউ জানে না। এ নির্বাচন জগলুকে কত দিনের নির্বাসন দিল কে জানে!
সূত্রঃ প্রথম আলো, ডিসেম্বর ডিসেম্বর ২২, ২০০৮
Leave a Reply