আমাদের নাট্য-আন্দোলনের একজন পথিকৃত্ সাঈদ আহমদ। তিনি একধারে লেখক, নাট্যকার, চিত্র সমালোচক ও সংস্কৃতিবেত্তা। ঢাকা আমার ঢাকা তাঁর ঢাকাকেন্দ্রিক এবং স্মৃতিচারণামূলক রচনা। একটি বিশেষ সময়ের নাগরিক জীবনের প্রবহমান স্রোতে লেখকের নিত্য অবগাহনের নানা বিভঙ্গ এখানে প্রতিফলিত। লেখক বিংশ শতাব্দীর চল্লিশ দশকের ঢাকা শহরের নানা প্রতিষ্ঠান ও কুশীলবদের মঞ্চে হাজির করেছেন। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সমাজজীবন, নানা ঘটনা, শিক্ষার আবহ, নাট্যচর্চা, উৎসব, বিনোদন এবং নগরবাসীর ভোজনবিলাস—সব কিছুকেই ছুঁয়ে গেছে তাঁর ঢাকা বসবাসের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার নির্যাস।
বইটি ঢাকা চর্চার তালিকায় একটি নতুন সংযোজন। বইটি ঢাকা বন্দনাই শুধু নয়, এটি লেখকদের ইতিহাসবোধ ও আনন্দরসের যুগল সম্মিলন। বইটিকে ঢাকাকেন্দ্রিক অনেকগুলো রচনা। ঢাকার মহল্লাভিত্তিক পঞ্চায়েত প্রথার প্রধান সরদারদের সঙ্গে লেখকের আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকায়, পঞ্চায়েত প্রথা এবং এর মুখ্য সরদারদের প্রবাদপ্রতিম জীবন সম্পর্কে একটি অন্তরঙ্গ ছবি ফুটে উঠেছে তাঁর কলমে। ‘ঢাকার সরদারদের গল্প’-এ শহরের নতুন মুসলিম মধ্যবিত্তের বিকাশে সরদারদের অবদান যেমন বিধৃত হয়েছে, তেমনি তুলে ধরা হয়েছে ঢাকার নাট্যচর্চা, সংগীত ও প্রেক্ষাগৃহের প্রসারে তাদের অগ্রণী ভূমিকা। কজন জানেন যে এই সরদারদের প্রতিষ্ঠিত ডায়মন্ড থিয়েটার (পরবর্তী সময়ে লায়ন থিয়েটার) ছিল ঢাকার সংস্কৃতিচর্চার সূতিকাগার। শুরুর দিকে লায়ন থিয়েটারে শুধু নাটকই মঞ্চস্থ করা হতো।
লেখক তাঁর চাচা মির্জা আবদুল কাদের ওরফে কাদের সরদারের নেতৃত্বে ঢাকার হিন্দু-মুসলিম পারস্পরিক হূদ্যতার কাহিনির উল্লেখ করতে গিয়ে জানিয়েছেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কাদের সরদার বিরোধী দল গঠনে ভূমিকা রাখেন। এ নিয়ে খাজা হাবিবুল্লাহর সঙ্গে মতবিরোধ ঘটে এবং তাঁদের সম্পর্কের অবনতি হয়। নবাব সাহেব যখন দেনার দায়ে জর্জরিত, দিশেহারা, তখন সব রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে তাঁর সাহায্য এগিয়ে এসেছিলেন কাদের সরদার।
‘সেদিনের ঈদ আয়োজনের গল্প’-এ ঢাকার মুসলিম সমাজের আনন্দ-উৎসবের একটি হারানো ছবি লুকিয়ে রয়েছে। তিন-চার রোজার পরই ঢাকার মুসলমানের বাড়িতে ঢোল বাজিয়ে গীত গাওয়ার আসর বসত। আর বাড়ির মহিলারা রাত জেগে সেলাই করতেন মেয়েদের পোশাক। সে সময়ে ১২ বছরের ওপর হলে শাড়ি পরতে হতো প্রত্যেক মেয়েকে। ঈদের শাড়ি তৈরি হতো বাড়িতে, বাইরে থেকে শাড়ি কিনে এনে এমব্রয়ডারি আর সুতির কাজে ডিজাইন দিয়ে। ছাদে পাটি বিছিয়ে মেরাসিন মেয়েদের আনন্দের গান শুনতে শুনতে এই সুচিকর্ম চলত প্রায় রোজার মাস ধরে। উত্তর ভারত থেকে এসেছিল মেরাসিনরা, তাদের পেশাই ছিল গান গাওয়া। আজ এরা ঢাকা থেকে হারিয়ে গেছে।
নাগরিক জীবনের বিভিন্ন সমস্যাকে শাসকগোষ্ঠীর বিরাগভাজন না হয়েও যে অনুগত প্রজা হিসেবে তুলে ধরা সম্ভব—সেই তথ্য পাওয়া গেছে ‘ঢাকার জন্মাষ্টমীর মিছিল’-এর একটি সংয়ের বর্ণনায়।
তেঁতাল্লিশের মন্বন্তরের সময় ঢাকায় খাবার তো দূরের কথা, খোলাবাজারে কাপড়ও পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছিল। সে সময়ের ইসলামপুরের জন্মাষ্টমীর মিছিলে নবাবপুরের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী শশীবাবু চটের কাপড়ের স্যুট পরে মোটরগাড়িতে চেপে ইংরেজদের মর্মপীড়া দিয়েছিলেন। এর কয়েক দিন পর ঢাকার কমিশনার চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন জনগণের কষ্ট তারা বুঝতে পেরেছেন এবং এই সমস্যার সুরাহা করা হবে। এর পরই ঢাকায় ত্রাণের কাপড়ের বান্ডিল এসেছিল বলে লেখক জানিয়েছেন। তাঁর মজলিশি ঢঙ রচনাগুলোকে উপাদেয় করে তুলেছে।
‘আমার নাটকের গল্প’ নাট্য-আন্দোলনের সঙ্গে লেখকের দীর্ঘ যোগসূত্রের উষালগ্নের কাহিনি। আছে নাট্য জগতে তাঁর ধীরে ধীরে উত্তরণের পর্ব, সঙ্গে রয়েছে ছেলেমেয়ের মিলিত নাটক মঞ্চস্থ করার বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ভাইস চ্যান্সেলরের নিষেধাজ্ঞা জারির তথ্য। ঢাকা ইংলিশ ড্রামাটিক সোসাইটির সভ্যদের বিওনী রেলওয়ে ইনস্টিটিউটে (পরবর্তীকালের মাহবুব আলী ইনস্টিটিউট) মঞ্চস্থ মার্চেন্ট অব ভেনিস-এর ব্যাপক সফলতার আনন্দ তাঁর লেখনীতে আজও জড়িয়ে আছে।
‘ঢাকার প্রথম মোটরগাড়ি শো’ একটি তথ্যসমৃদ্ধ এবং কৌতূহলোদ্দীপক রচনা। ১৯৪০-এ দেশজুড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আতঙ্ক। জাপান ইতিমধ্যে বোমা ফেলেছে কক্সবাজারে। বাংলার গভর্নর স্যার হাবার্ট রিড ঢাকায় এসেছেন। যুদ্ধের মধ্যেও ঢাকাবাসীর মনোবল যাতে অটুট থাকে, গভর্নর সেজন্য ঢাকার জমিদার ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নির্দেশ দিলেন মোটর শোর ব্যবস্থা করতে।
যেহেতু যুদ্ধের ঢেউ এ দেশে এসে লেগেছে, তাই যুদ্ধকে প্রতীক করে কাদের সরদার তাঁর নতুন অস্টিন গাড়িটি সাজিয়ে প্রদর্শনীতে পাঠালেন। একটি ময়ূর সাপ মারছে—এই দৃশ্যটি গাড়িতে ফুটিয়ে তোলা হলো। জার্মানির হিটলার সাপ আর ব্রিটিশ সম্রাট ময়ূরের প্রতীক, শান্তিরূপী ময়ূর হিটলাররূপী সাপকে ধ্বংস করছে। ১৯ জুলাই, ১৯৪০ সালে রমনার বেসকোর্সে মোটর শো অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ইংরেজের বিজয়ের সম্ভাবনাকে প্রতীকের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলে কাদের সরদারই ২০ জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে প্রথম পুরস্কারটি ছিনিয়ে নিয়েছিলেন।
‘যতীন অ্যান্ড কোম্পানি’ প্রবন্ধে দেখা মেলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিষে জর্জরিত ব্যথাহত সাঈদ আহমদকে, যিনি একচল্লিশ সালের একটা বড় অংশজুড়ে ঢাকায় দাঙ্গার ‘ক্ষমাহীন পাপের’ এক অসহায় দর্শক। লেখক দেখেছেন ১২-১৪ বছরের বাচ্চা ছেলেদের পাড়ার দাদাদের ছুরি চালানোয় হাতেখড়ি দিতে। ‘কচি মাস্তানদের দাপটে রমরমা, কীভাবে তারা তৈরি হতো দাগি অপরাধী হিসেবে, চোখের সামনে সেসব দৃষ্টান্বিত হতে দেখেছি।’ লেখকের কলমে ফুটে উঠেছে এমনই অসহায় আর্তি।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, কোনো শহরের সাংস্কৃতিক জীবন জানতে হলে সেখানকার খাবার-দাবারের দিকেও নজর দিতে হয়। সমাজ ও নাগরিক জীবনের পরিবর্তনের হাত ধরেই মানুষের খাদ্যরুচির পরিবর্তন ঘটে। বাড়ি বাড়ি গান গেয়ে সকালের নাশতা বিক্রি করা ঢাকার পিঠে পিঠাওয়ালিরা আমাদের রুচির পরিবর্তনের কারণে হারিয়ে গেল। ‘ঢাকার পিঠাওয়ালির গল্প’-এ ঝাল মিষ্টি তেলবিহীন সেই সব পিঠার সঙ্গে ফাও হিসেবে তারা আরও একটি উপাদেয় বস্তু ধরিয়ে দিত—ভূতপ্রেত আর জিন-পরিদের গা হিম করা গল্প। ‘সুস্বাদু পাগলার গেলাসি’ আবার মনে করিয়ে দেয় বঙ্গসন্তানের ‘বাসনার সের বাসা রসনায়’।
তরতরে গল্পের স্রোতে ভাসতে ভাসতে লেখকের পিছে ফিরে তাকানোর সঙ্গে যোগ হয়েছে তাঁর ধীর শান্ত কথনভঙ্গি। মাঝেমধ্যে নিজের কথা অনিবার্যভাবে উঠে এসেছে, তবে তা কখনোই মূল প্রতিপাদ্য অর্থাৎ ঢাকা শহরের অধিবাসীদের যাপিত জীবনের কাহিনিকে ছাপিয়ে নয়। বইটিতে একটি ভূমিকা সংযোজিত হলে এর গৌরব আরও বাড়ত।
আগামী সংস্করণে সংক্ষিপ্ত একটি নির্ঘণ্টের প্রত্যাশা তরুণ প্রজন্মের পাঠকেরা করতেই পারেন। জর্জ চিনারির আঁকা ছবি দুটো পাঠকের একটি অতিরিক্ত পাওয়া। রাজধানী ঢাকার চার শ বছর পূর্তি উৎসবের বিবিধ আয়োজনে এই গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে প্রাসঙ্গিক সংযোজন বরে বিবেচিত হবে।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, এপ্রিল ১৬, ২০১০
Leave a Reply